গ' বিভাগ
বাংলার ইতিহাস। অনার্স তৃতীয় বর্ষ।
আজকের আলোচনা, ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলনের কারণ ও এর গুরুত্ব।
ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলন। |
প্রশ্নঃ ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলনের কারণ ও গুরুত্ব বিস্তারিত আলোচনা কর।
অথবা, ভারতে ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলন সংঘটিত হওয়ার কারণ কি ছিল? এ আন্দোলনের গুরুত্ব বর্ণনা কর।অথবা, ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলন কেন হয়েছিল? বাংলার সমাজে এ আন্দোলনের গুরুত্ব আলোচনা কর।
উত্তর: ভূমিকা: ভারতীয় উপমহাদেশে উনিশ শতকে সমাজ সংস্কারের জন্য অনেক আন্দোলন হয়েছিল, যার মধ্যে অন্যতম হলো ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলন। এই আন্দোলন হিন্দুধর্মের নানা বৈষম্যমূলক রীতি ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠে। এ আন্দোলনের নেতারা ছিলেন পশ্চিমা শিক্ষা ও সাহিত্য দ্বারা প্রভাবিত এবং ভলতেয়ার, লক, হিউ মিলের মত দার্শনিকদের চিন্তাধারায় উদ্বুদ্ধ। যারা এই আন্দোলনে বাস্তবজ্ঞান, সামাজিক সাম্য ও মানবকল্যাণের পক্ষে এবং ধর্মীয় কুসংস্কারের বিপক্ষে অবস্থান নেন। এই আন্দোলনটি মূলত হিন্দু কলেজ থেকে শুরু হয়ে অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছড়িয়ে পড়ে। যদিও এ আন্দোলনটি উদার চিন্তার পথে অগ্রসর হয়েছিল তবুও ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে বেশি দিন টিকে থাকতে পারেনি।ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলন: ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলন ছিল হিন্দু কলেজের কিছু উদারচিন্তা সম্পন্ন ছাত্রের একটি দল, যারা শিক্ষক হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও-এর অনুসারী ছিলেন। ডিরোজিও ১৮২৬ থেকে ১৮৩১ সাল পর্যন্ত হিন্দু কলেজে শিক্ষকতা করেন। তিনি তার ছাত্রদের যুক্তিসিদ্ধ ভাবনা, অন্ধবিশ্বাস ত্যাগ, এবং সত্যের জন্য জীবন উৎসর্গ করার শিক্ষা দিয়েছিলেন। তিনি দেখিয়েছিলেন কিভাবে সমাজ গড়ে ওঠে এবং মানুষ সেকেলে ধারণায় আবদ্ধ থাকে। তার মূলনীতি ছিল "সত্যের জন্য বাঁচা, সত্যের জন্য মারা।" আর তার এই আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, শিবচন্দ্র ঘোষ, প্যারিচাদ মিত্রের মত হিন্দু কলেজের মেধাবী ছাত্ররা হিন্দু সমাজ থেকে সকল প্রকার কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস দূর করতে এই ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন।
ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলনের কারণ: কতগুলো ধর্মীয় ও সামাজিক কারণে ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল নিম্নে সে কারণগুলো আলোচনা করা হলো।
১.হিন্দু সমাজের কুসংস্কার দূরীকরণ: তৎকালীন ভারতীয় হিন্দু সমাজ বিভিন্ন কুসংস্কারে পরিপূর্ণ ছিল। আর ডিরোজিও তার অনুসারীদের হিন্দু সমাজের ধর্মীয় ও সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হতে শিক্ষা দিয়েছিলেন। তার এই শিক্ষায় প্রভাবিত হয়ে একদল মেধাবী ছাত্ররা প্রাচীন প্রথা ও ধর্মীয় শৃঙ্খল থেকে মুক্তির চেষ্টা করেন। তারা ধর্মীয় কুসংস্কার ও নিষ্ঠুর রীতির বিরুদ্ধে খ্রিস্টান মিশনারিদের দেওয়া বিভিন্ন যুক্তি গ্রহণযোগ্য বলে মনে করতেন। তাই তারা হিন্দু সমাজের সকল কুসংস্কার দূরকরতে ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন।
২.বর্ণবাদের বিরোধিতা: তখনকার হিন্দুসমাজে বর্ণভেদ প্রথা ব্যাপক ছিল। সমাজে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, এবং শূদ্র চারটি বর্ণে শ্রেণীবিভক্ত ছিল। ব্রাহ্মণরা সবচেয়ে বেশি সুযোগ পেত ও ভালো জীবন যাপন করতো, আর শুধুমাত্র ব্রাহ্মণদের সন্তানরাই স্কুলে পড়াশোনা করতে পারতো। তাদের নিম্নবর্ণের মানুষের সাথে সম্পর্ক নিষিদ্ধ ছিল। এ সকল বৈষম্য তখন ব্যাপক আকার ধারণ করেছিল। আর ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলনকারীরা এই সামাজিক সাম্যর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল।
৩.পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রতি গুরুত্বারোপ: ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলনের অন্যতম কারণ ছিল বাঙালিদেরকে গতানুগতিক শিক্ষার ছাড়াও পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রতি জোর দেয়া। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল এদেশের মানুষ বাস্তব জ্ঞানের বাইরে শুধু অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারে আচ্ছন্ন হওয়ার কারণে মনগড়া মতবাদ ও বৈষম্য গড়ে তুলেছে। তাই আন্দোলনকারীরা পাশ্চাত্য শিক্ষাকে প্রাধান্য দেওয়ার জন্য বিজ্ঞান, আইন ও সাহিত্য শিক্ষাকে গুরুত্ব দেয়। ভারতবাসীকে বৈজ্ঞানিক মতবাদ, যুক্তিবাদ, সাম্য ও মানবতার আদর্শ এবং আধুনিক স্বাতন্ত্র্যবাদে উদ্বুদ্ধকরণে কাজ করেন।
৪.আদর্শ মানুষ গঠন: ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলনের নেতা ও হিন্দু কলেজের শিক্ষক ডিরোজিও তার ছাত্রদের শুধু শিক্ষা নয়, আদর্শ মানুষ ও নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠার দীক্ষা দেন। তিনি ছাত্রদের মধ্যে বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তাধারা বিকাশ এবং নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানোর চেষ্টা করেন। ডিরোজিও তাদের নৈতিক চরিত্র গঠন ও আধুনিক মানুষ হিসেবে সমাজে নিজেদের প্রতিষ্ঠার জন্য দিকনির্দেশনা দেন। তিনি পড়াশোনার পাশাপাশি আদর্শবাদ ও নৈতিক মূল্যবোধের চর্চাকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন।
৫.ধর্মীয় অন্ধবিশ্বাসের বিরোধিতা: ডিরোজিওর অনুসারীরা বিশ্বাস করতেন যে ধর্মের কিছু নিয়ম মানবকল্যাণের বিরোধী। তারা ধর্মীয় অন্ধবিশ্বাস এবং হিন্দুধর্মে বিধবাদের প্রতি অন্যায় আচরণের তীব্র প্রতিবাদ করেন। বিধবা নারীদের খাওয়া-দাওয়া, পোশাক, চলাফেরা ও পুনর্বিবাহে বিধি-নিষেধসহ অস্পৃশ্যতা ও খাদ্য-অখাদ্য ব্যবস্থার বিরোধিতা করেন। তারা দাস ব্যবসা নিষিদ্ধ করার দাবিতে আন্দোলন করেন। ইয়ং বেঙ্গলের সদস্যরা পার্থেনন পত্রিকার মাধ্যমে হিন্দু সমাজের কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসের বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রচার চালান।
ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলনের গুরুত্ব: ভারতে ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলন কিছুদিন বেশ গুরুত্ব পেয়েছিল। নিম্নে এ আন্দোলনের গুরুত্ব আলোচনা করা হলো
১.একাডেমিক এসোসিয়েশন গঠন: আন্দোলনের কার্যক্রম পরিচালনা ও ছাত্রদের স্বাধীন চিন্তাধারা বিকাশের জন্য ডিরোজিও ১৮২৬ সালে একাডেমিক এসোসিয়েশন গঠন করেন। এখানে ঈশ্বর, পৌত্তলিকতা, পুরোহিততন্ত্র ও কুসংস্কার নিয়ে খোলামেলা আলোচনা ও বিতর্ক হতো। ডিরোজিওর ছাত্ররা ভলতেয়ার, হিউম, লক প্রমুখের রচনা অধ্যয়ন করতেন এবং আলোচনায় উল্লেখ করতেন। এই সভায় বিখ্যাত ব্যক্তিদের আমন্ত্রণ জানানো হতো, এবং ইয়ং বেঙ্গলের সদস্যরা তাদের যুক্তিবাদী মনোভাব ও বাগ্মিতা প্রকাশ করতেন।
২.এসোসিয়েশনের কার্যক্রম: ডিরোজিও একাডেমিক এসোসিয়েশনের সভাপতি ছিলেন। এই এসোসিয়েশন হিন্দু সমাজ ও ধর্মের কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানাত। সদস্যরা বলতেয়ার, হিউম, লক, টম পেইনের রচনা গভীরভাবে অধ্যয়ন করে সেই জ্ঞান ব্যবহার করতেন। লাল বিহারী দেব একে যুবক সিংহদের গর্জন হিসেবে বর্ণনা করেছেন। টম পেইনের এজ অব রিজন বইটি খুব দ্রুত বিক্রি হতো, এবং অ্যাডাম স্মিথসহ আধুনিক চিন্তাবিদদের রচনা তাদের প্রিয় পাঠ্য ছিল। মতবাদ প্রচারের জন্য ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠী বেশ কয়েকটি পত্রিকা প্রকাশ করেছিল।
৩.সোসাইটি ফর দি অ্যাকুইজেশন অব জেনারেল নলেজ: ১৮৩৮ সালে ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠী "সোসাইটি ফর দি অ্যাকুইজেশন অব জেনারেল নলেজ" নামে একটি সংগঠন গঠন করে। তারাপদ চক্রবর্তী সোসাইটির সভাপতি হন, আর প্যারিচাঁদ মিত্র ও রামতনু লাহিড়ী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
৪.পত্র-পত্রিকা প্রকাশ: ১৮২৮ থেকে ১৮৪৩ সালের মধ্যে ডিরোজিওর শিষ্যরা বিভিন্ন পত্রিকা প্রকাশ করেন। ১৮৩০ সালে পার্থেনন প্রকাশিত হলেও তা দ্রুত বন্ধ হয়ে যায়। মিশনারিদের প্রভাবে তারা জ্ঞানান্বেষণ প্রকাশ করেন। কৃষ্ণমোহন এনকোয়েরার পত্রিকায় চরমপন্থি রক্ষণশীলদের সমালোচনা করেন। হিন্দু পাইওনিয়ার এবং কুইল পত্রিকায় সরকারের নীতির সমালোচনা করা হতো। ইয়ং বেঙ্গলের শেষ পত্রিকা ছিল বেঙ্গল স্পেকটেটর, যেখানে সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সমস্যাগুলোর ওপর লেখা প্রকাশিত হতো।
৫.পাশ্চাত্য চিকিৎসাশাস্ত্রের প্রচলন: ভারতে পাশ্চাত্য চিকিৎসাশাস্ত্র প্রচলনে ইয়ং বেঙ্গল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তাদের প্রচেষ্টায় ১৮৩৫ সালে কলকাতা মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। তারা শবব্যবচ্ছেদ নিয়ে সমাজের সংস্কার ভাঙতে মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের উৎসাহিত করেছিল।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলন ছিল ভারতের এক ভিন্নধারার সংস্কার আন্দোলন, যা সমাজের অসামঞ্জস্য ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে উদার দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিষ্ঠা করাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। আর তাদের নেতৃত্ব ছিলেন হিন্দু কলেজের একজন শিক্ষক ডিরোজিও, যিনি তার ছাত্রদেরকে এ পথে পরিচালিত করেন। তবে তার এই উদার নীতি রক্ষণশীল সমাজের ধর্মীয় বিশ্বাসে আঘাত হানে, বিশেষ করে হিন্দুধর্মীয় রীতি-নীতির বিরুদ্ধে। এর ফলে রক্ষণশীল হিন্দুরা এর বিরোধিতা করে এবং শেষ পর্যন্ত আন্দোলনটি স্তিমিত হয়ে পড়ে। তবে এই আন্দোলন সফলতা অর্জন না করলেও পরবর্তিতে ভারতীয় হিন্দু সমাজ সংস্কারে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।