“হিন্দু বিধবা বিবাহ” আইনের প্রেক্ষাপট ও গুরুত্ব আলোচনা কর।

হিন্দু বিধবা বিবাহ আইন (১৮৫৬): প্রেক্ষাপট ও গুরুত্ব

গ' বিভাগ

বাংলার ইতিহাস। অনার্স ৩য় বর্ষ।

অজকের আলোচনা, “হিন্দু বিধবা বিবাহ” আইনের প্রেক্ষাপট ও গুরুত্ব।

“হিন্দু বিধবা বিবাহ” আইনের প্রেক্ষাপট ও গুরুত্ব আলোচনা কর।
“হিন্দু বিধবা বিবাহ” আইনের প্রেক্ষাপট ও গুরুত্ব।


প্রশ্নঃ ''হিন্দু বিধবা বিবাহ'' আইনের প্রেক্ষাপট ও গুরুত্ব বিস্তারিত আলোচনা কর।

অথবা, কোন প্রেক্ষাপটে হিন্দু বিধবা বিবাহ আইন পাশ হয়? এর গুরুত্ব আলোচনা কর।
অথবা, হিন্দু বিধবা বিবাহ'-এর কোন ঘটনার প্রেক্ষিতে বিবাহ করার অনুমতি পেয়েছে? এর গুরুত্ব সম্পর্কে বর্ণনা দাও।

 উত্তর:  ভূমিকা: ভারতীয় উপমহাদেশে হিন্দুধর্মের অনুসারীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও এর অনেক প্রাচীন প্রথা মানবকল্যাণের পরিবর্তে শোষণ ও অসাম্যের প্রতীক হয়ে ওঠে। সতীদাহ প্রথা ও বিধবা বিবাহ নিষিদ্ধকরণ তার অন্যতম উদাহরণ। ভারতীয় হিন্দুধর্মে কোনো হিন্দু নারী স্বামী হারালে তাকে পুনর্বিবাহের সুযোগ দেওয়া হতো না, যা নারীদের জন্য ছিল চরম অমানবিক। উনিশ শতকে, যখন ভারত ব্রিটিশ শাসনের অধীনে ছিল, ইংরেজরা ইউরোপীয় জীবনধারা প্রচলনের চেষ্টা করলেও এসব প্রথার বিরুদ্ধে কোনো আইনগত উদ্যোগ নেননি। তবে এ সামাজিক অসাম্যের বিরুদ্ধে  ইয়ং বেঙ্গল নামে একটি সংগঠন গড়ে ওঠে, যারা ত্রিশের দশকে এপ্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের নেতৃত্বে এই আন্দোলন পঞ্চাশের দশকে চূড়ান্ত সাফল্য লাভ করে এবং ব্রিটিশ সরকার বাধ্য হয়ে বিধবা বিবাহ আইন পাস করে। আর এটি নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হয়।
হিন্দু বিধবা বিবাহ আইনের প্রেক্ষাপট: ঊনবিংশ শতাব্দীতে সমাজ সংস্কারের জন্য যে কয়টি আন্দোলনের ইতিহাস পাওয়া যায় তার মধ্যে হিন্দু বিধবা পুনর্বিবাহ আন্দোলন অন্যতম। যেটা পরবর্তীতে আইনগতভাবে স্বীকৃতি পায়। নিম্নে এ আইনের প্রেক্ষাপট আলোচনা করা হলো।
১.রাজা রাজবল্লভের উদ্যোগ: ঊনবিংশ শতাব্দীর পূর্বে হিন্দু সমাজে বিধবা বিবাহ নিষিদ্ধ ছিল। বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহের ব্যাপক প্রচলনের কারণে সমাজে বিধবার সংখ্যা বেড়ে যায়। এতে সমাজ সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। সর্ব প্রথম রাজা রাজবল্লভ এই উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। তার কন্যা অল্প বয়সে বিধবা হলে, তিনি হিন্দু শাস্ত্র বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে জানতে পারেন যে, অল্পবয়সী বিধবার পুনর্বিবাহ শাস্ত্রবিরোধী নয়। এর ভিত্তিতে তিনি কন্যার পুনর্বিবাহের প্রচেষ্টা শুরু করেন, যা বিধবা বিবাহের পক্ষে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল।
২.রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের বিরোধিতা: রাজা রাজবল্লভ অল্পবয়সী বিধবা কন্যার পুনর্বিবাহের জন্য শাস্ত্রের অনুমতি পেলেও নদীয়ার মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র এর তীব্র বিরোধিতার করে। যে কারনে রাজা রাজবল্লভ বিধবা বিবাহের প্রচলন করতে ব্যার্থ হয়।
৩.রামমোহন রায়ের ‘আত্মীয় সভা’: ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিধবা বিবাহ আন্দোলনকে সফল পর্যায়ে নিয়ে গেলেও তার পূর্বে রাজা রামমোহন রায় এই প্রথা পরিবর্তনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ  ভূমিকা রাখেন। তিনি আত্মীয় সভার মাধ্যমে বিধবা বিবাহের পক্ষে মতামত প্রকাশ করেন এবং এ বিষয়ে লেখালেখি শুরু করেন, যা আন্দোলনের প্রাথমিক ভিত্তি গড়ে তুলতে সহায়ক ভূমিকা রাখে।
৪.পত্রপত্রিকার প্রচারণা: বিধবা বিবাহকে স্বীকৃতি দিতে ব্যক্তিগত উদ্যোগের পাশাপাশি সমষ্টিগত প্রচেষ্টাও শুরু হয়, যেখানে পত্র-পত্রিকার ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ১৮২৮-২৯ সালে ডিরোজিওর একাডেমিক এসোসিয়েশন বা ইয়ং বেঙ্গল বিধবা বিবাহের পক্ষে বিভিন্ন পত্রিকায় লেখালেখি করে জনমত গড়ে তোলার কাজ করে। সমাচার দর্পণ, জ্ঞানান্বেষণ, বেঙ্গল স্পেকটেটর, দর্পণ, রিফরমার প্রভৃতি পত্রিকা বিধবা নারীদের দুর্দশার কথা তুলে ধরে আন্দোলনের পক্ষে জনমত তৈরি করে।
৫.জাতীয় আইন কমিশনের উদ্যোগ: বিধবা পুনর্বিবাহ বৈধকরণের আন্দোলন ব্যক্তিগত উদ্যোগ দিয়ে শুরু হলেও পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে এর বার্তা সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়ে। এতে জাতীয় আইন কমিশনের দৃষ্টি আকর্ষিত হয়। সমাজের কল্যাণের জন্য তারা বাল্যবিধবাদের পুনর্বিবাহের গুরুত্ব স্বীকার করলেও কট্টর হিন্দুত্ববাদের বিপক্ষে তারা চূড়ান্ত পদক্ষেপ নিতে সাহস করেননি।
৬.সংগঠনের মাধ্যমে আন্দোলন: ঊনবিংশ শতাব্দীতে ভারতে বিধবা বিবাহের পক্ষে আন্দোলন ছিল কুসংস্কার ও কুপ্রথা দূরীকরণের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রচেষ্টা। বাঙালি সমাজের তত্ত্ববোধিনী সভা ও ধর্মসভা মতো সংগঠনগুলো এই বিষয়ে জনমত গঠনের চেষ্টা করেছিল। তবে তারা চূড়ান্ত সফলতা অর্জন করতে পারেনি। পরে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এই আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিলে তা ইতিবাচক গতিতে এগিয়ে গিয়ে লক্ষ্য পূরণের পথে অগ্রসর হয়।
৭.বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহ আন্দোলন: ব্রিটিশ শাসিত ভারতে হিন্দুদের ধর্মীয় গোঁড়ামি, কুসংস্কার ও কুপ্রথার বিরুদ্ধে যে কয়জন মনীষী আন্দোলন করে সফলকাম হয়েছেন তাদের মধ্যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর অন্যতম। ১৮২০ সালে পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুরের বীরসিংহ গ্রামে জন্মগ্রহণ করা এই মনীষী শৈশবেই সমাজের কুপ্রথা ও কুসংস্কার দেখে ব্যথিত হন। বিধবা নারীদের দুঃখ-দুর্দশা তাকে সবচেয়ে বেশি আন্দোলিত করে, যা তাকে বিধবা বিবাহের পক্ষে আন্দোলন করতে অনুপ্রাণিত করে। নিম্নে বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহ আন্দোলন সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরা হলো :
(i) আধুনিক চিন্তাধারা: বিদ্যাসাগরের মতে, পুরনো মূল্যবোধ ও পারিবারিক কুসংস্কার পরিবর্তন না করলে সমাজের প্রকৃত উন্নতি সম্ভব নয়। এজন্য তিনি বিধবা বিবাহ চালু, বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ নিষিদ্ধ করা এবং নারীশিক্ষা বিস্তারে প্রচেষ্টা শুরু করেন। বিধবা নারীদের দুঃখ মোচনে তিনি পুনর্বিবাহকে সমাধান হিসেবে দেখেন
(ii) প্রবন্ধ প্রকাশ: হিন্দু বিধবার দুরবস্থা বিদ্যাসাগরের মনে গভীর প্রভাব ফেলে। তিনি বিধবা বিবাহের পক্ষে শাস্ত্র থেকে যুক্তি তুলে ধরে তত্ত্বাবোধিনী পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখেন। ১৮৫৪ সালে তিনি বেঙ্গল স্পেক্টেটরে বেনামী প্রবন্ধ প্রকাশ করেন, যা এই আন্দোলনে বড় ভূমিকা রাখে। তার লেখনী জনমত গঠনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
(iii) গ্রন্থ রচনা: ১৮৫৩ ও ১৮৫৫ সালে বিদ্যাসাগর হিন্দু শাস্ত্র বিশ্লেষণ করে বিধবা বিবাহের পক্ষে দুটি বই প্রকাশ করেন। এখানে হিন্দু শাস্ত্রের বিভিন্ন শ্লোক বিশ্লেষণ করে অভূতপূর্ব যুক্তিসহকারে হিন্দু বিধবা রমণীদের বিবাহ দেয়ার পক্ষে মতামত তুলে ধরেন।
(iv) সরকারের কাছে আবেদন: ১৮৫৫ সালে তিনি প্রায় পঁচিশ হাজার স্বাক্ষর সংগ্রহ করে বিধবা বিবাহের পক্ষে সরকারের কাছে আবেদন করেন। সে সমস্ত শিক্ষিত হিন্দুদের একটি অংশ বিদ্যাসাগরকে সমর্থন করে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বারকানাথ মিত্র, চাকশি নারায়ণ মুখার্জী, রাজনারায়ণ বোস, রায়গোপাল ঘোষ প্রমুখ। এসময় সারা বাংলায় বিদ্যাসাগরের নাম ছড়িয়ে পড়ে।
(v) বিদ্যাসাগর কর্তৃক আইন বাস্তবায়ন: সরকারিভাবে বিধবাদের বিবাহ স্বীকৃতি পাওয়ার পর বিদ্যাসাগর এবং তার বন্ধুরা মিলে ১৮৫৬ সালের ডিসেম্বরে রক্ষণশীল সমাজের বিক্ষোভ এবং প্রচণ্ড বাধার মুখে ঘটা করে এক বিধবার বিবাহ দেন। পাত্র ছিল সংস্কৃত কলেজে বিদ্যাসাগরের একজন সহকর্মী। তাছাড়া বিদ্যাসাগর নিজের একমাত্র পুত্রের সাথে বিধবার বিবাহ দিতে তিনি দ্বিধাবোধ করেননি।
হিন্দু বিধবা বিবাহ আইনের গুরুত্ব: একসময় হিন্দু সমাজে বিধবা নারীদের জীবন ছিল অত্যন্ত দুর্বিষহ। স্বামী মারা গেলে নারীদের কঠোর কুসংস্কার মেনে চলতে বাধ্য করা হতো। তাদের বাপের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হতো, আর সংসারে কোনো সম্মান থাকত না। তাদের চুড়ি, সিঁদুর, শাড়ি—সব সৌন্দর্যের চিহ্ন ত্যাগ করতে বাধ্য করা হতো। এমনকি খাওয়ার ক্ষেত্রেও তাদেরকে নিয়ম মেনে চলতে হত, তারা নিরামিষ ছাড়া কিছু খেতে পারত না। বাড়ির সব কঠিন কাজ তাদের দিয়ে করানো হতো, অথচ তাদের পুনর্বিবাহের কথা ভাবাও পাপ বলে ধরা হতো। এই অমানবিক পরিস্থিতি পরিবর্তনের জন্য বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সমাজ সংস্কারক আন্দোলন শুরু করেন। কিন্তু বাস্তব ফল আসে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের নিরলস প্রচেষ্টায়। তার আন্দোলনের ফলে বিধবা বিবাহ আইন পাস হয়। এই আইনের মাধ্যমে বিধবা নারীরা পুনরায় বিয়ে করার অধিকার পায় এবং স্বাভাবিক নারীদের মতো সম্মানজনক জীবনযাপন করতে শুরু করে। 
এই আইন শুধু নারীদের জীবনে নতুন আশার আলো আনেনি, বরং একটি কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজ থেকে নিষ্ঠুর প্রথা দূর করার মাধ্যমেও যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছিল। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের এই আন্দোলন ও সফলতা তাকে ভারতীয় সমাজের ইতিহাসে স্মরণীয় করে রেখেছে।
উপসংহার: আলোচনার পরিশেষে বলা যায় যে, ভারতীয় উপমহাদেশে একসময় হিন্দু সমাজে বিধবা নারীদের জীবন ছিল খুবই কষ্টকর। স্বামী মারা গেলে তাদের বাপের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হতো, সৌন্দর্যের সব চিহ্ন ত্যাগ করতে হতো, আর খাবারের ক্ষেত্রেও তাদের নিরামিষ ছাড়া কিছু খেতে দেওয়া হতো না। তারা কোনো সম্মান পেত না, এবং পুনর্বিবাহের চিন্তাও পাপ বলে ধরা হতো। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের আন্দোলনের ফলে বিধবা বিবাহ আইন পাস হয়। এই আইনের মাধ্যমে বিধবা নারীরা পুনরায় বিয়ের অধিকার ও স্বাভাবিক জীবনের সুযোগ পায়।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন