গ' বিভাগ
বাংলার ইতিহাস। অনার্স তৃতীয় বর্ষ।
অজকের আলোচনা, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কী? ও এর দোষ-গুণ।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত |
প্রশ্নঃ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কী? এর দোষ-গুণ আলোচনা কর।
উত্তর: ভূমিকা: ভারতবর্ষে কোম্পানির শাসনামলে যে কয়জন গভর্নর নিজেদের জনকল্যাণমূলক কাজের জন্য আজও স্মরণীয় হয়ে আছেন তন্মধ্যে অন্যতম একজন গভর্নর ছিলেন লর্ড কর্ণওয়ালিশ। ১৭৮৬ সালে লর্ড কর্ণওয়ালিশকে বাংলার গভর্নর নিযুক্ত করেন। তিনি বাংলায় আসার পর বাংলার বিশৃঙ্খল ভূমি রাজস্বনীতির একটি স্থায়ী সমাধানের জন্য চেষ্টা করতে থাকেন। পরে দীর্ঘ আলোচনা পর্যালোচনা পর ১৭৯৩ সালের ২২ মার্চ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কার্যকর করা হয়। এই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে বাংলার সমাজ ও অর্থনীতির উপর একটা মারাত্মক প্রভাব পড়ে।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত: চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বলতে ১৭৯৩ সালে ব্রিটিশ শাসনামলে লর্ড কর্নওয়ালিস কর্তৃক প্রবর্তিত এক ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থাকে বোঝানো হয়। এটি ভারতীয় উপমহাদেশে একটি বিশেষ ভূমি-ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি যেখানে জমিদারদের ভূমিকর সংগ্রহের দায়িত্ব স্থায়ীভাবে প্রদান করা হয়েছিল। এই ব্যবস্থা অনুযায়ী ভূমি থেকে রাজস্বের পরিমাণ স্থায়ীভাবে নির্ধারণ করা হয়। এটির কোনো রুপ পরিবর্তন করা হতো না আর জমির মালিকানা জমিদারদের কাছে থাকত। তারা কৃষকদের কাছ থেকে কর সংগ্রহ করে সরকারের কাছে প্রদান করত। এ ব্যবস্থায় সরাসরি কৃষকদের জমির মালিকানা দেওয়া হয়নি। তাদের শুধু চাষ করার অধিকার ছিল, এবং তারা অধিক করের শিকার হতো। এ ব্যবস্থার উদ্দেশ্য ছিল সরকারের স্থায়ী আয় নিশ্চিত করা এবং জমিদারদের ব্রিটিশ শাসনের প্রতি আনুগত্য বৃদ্ধি করা ও জনগনের সাথে সরকারের সম্পর্ক স্থাপন করা। কিন্তু জমিদাররা স্থায়ী ভাবে জমির মালিক হওয়ায় ও সূর্যাস্ত আইনের কবল থেকে বাঁচতে কৃষকদের ওপর অতিরিক্ত কর চাপিয়ে আর্থিকভাবে দুর্বল করে তোলে। এতে কৃষকদের জীবনমান খারাপ হয়ে পড়ে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার এবং ওড়িশা প্রদেশে কার্যকর করা হয়েছিল। এটি ঔপনিবেশিক শাসনের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হিসেবে বিবেচিত।
নিম্নে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ইতিবাচক দিকগুলো আলোচনা করা হলো:-
১.রাজস্ব আয় ও বাজেট সম্পর্কে ধারণা: চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রধান সুবিধা ছিল কোম্পানির রাজস্ব আয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া। এতে তারা কোম্পানির বাৎসরিক আয় সম্পর্কে ধারণা পায় যারফলে তাদের বাৎসরিক বাজেট প্রস্তুতের সুবিধা হয়।
২.প্রজাদের উন্নতি: চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে কোম্পানি থেকে জমিদারগণ স্থায়ীভাবে জমির মালিক হয় এতে প্রজাসাধারণের উপকার হয়। কারণ জমিদাররা স্থায়ীভাবে জমির মালিক হওয়াতে তারা প্রজাদের জন্য প্রয়োজনীয় রাস্তা-ঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট, বিদ্যালয় ইত্যাদি নির্মাণ করেন।
৩.কুঠির শিল্পের উন্নতি: চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত লাভ করার ফলে গ্রামাঞ্চলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ধরনের কুঠির শিল্পের ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়। যা তখনকার অর্থনীতিতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
৪.নতুন জমিদার শ্রেণির উদ্ভব: চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে সুর্যাস্ত আইনের কোপানলে পড়ে অনেক পুরাতন জমিদার তাদের জমিদারি হারায়। ফলে অনেক নতুন নতুন জমিদার শ্রেণির উদ্ভব ঘটে।
৫.কর্মচারীদের দক্ষতাবৃদ্ধি: ইতিপূর্বে রাজস্ব আদায়ে কোম্পানির কর্মচারীরা ছিল পুরোপুরি ব্যর্থ। কারণ তাদের বাংলার রাজস্ব প্রশাসন সম্পর্কে তেমন কোনো ধারণা ছিল না। ফলে তারা ব্রিটিশের রাজস্ব নীতি বাংলায় প্রয়োগের চেষ্টা করলে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। এই বন্দোবস্তের ফলে কোম্পানরি কর্মচারীরা বাংলার রাজস্ব প্রশাসন সম্পর্কে আরো দক্ষতা অর্জনে সক্ষম হয়।
নিম্নে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের নেতিবাচক দিকগুলো আলোচনা করা হলো:
১.পুরাতন জমিদারি বিলুপ্তি: চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের একটি উল্লেখযোগ্য নেতিবাচক দিক ছিল সূর্যাস্ত আইন। এই আইনের ফলে অনেক জমিদার পরিবার নির্দিষ্ট সময়ে অর্থ জমা না দিতে পারায় তারা বিলুপ্তি হয়ে যায়।
২.রায়তের ওপর অত্যাচার: জমিদারগণ যেমন সরকার থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ রাজস্ব দেওয়ার শর্তে জমি ভোগ দখলের স্থায়ী অধিকার পায়, তেমনি তারাও রায়তদের অনুরূপ শর্তে জমি বন্দোবস্ত দেবেন। কিন্তু এই শর্ত লংঘন করে জমিদাররা ঠুনকো অজুহাতেই রায়তদের জমি থেকে উচ্ছেদ করতে পারত।
৩.রাজস্ব নির্ধারণে ত্রুটি: চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে অধীনে কি পরিমাণ জমি নিষ্কর ছিল, কি পরিমাণ জমিতে পশুচারণ ছিল তা খোজখবর না নিয়ে জমিদারদের কাছ থেকে ধারণা নিয়ে রাজস্ব নির্ধারণ করা হয় এর ফলে রাজস্বের মাত্রা বেশি হয়েছিল। যার কারণে রাজস্বকে কেন্দ্র করে প্রচুর মামলা মকদ্দমার সৃষ্টি হয়।
৪.সরকারের আর্থিক ক্ষতি: ১৭৯৩ সালে জমির যে মূল্য ছিল এ ব্যবস্থা প্রবতর্নের ফলে তা দ্বিগুণ বেড়ে যায়। কিন্তু তাতে সরকারের নির্দিষ্ট রাজস্বের কোনো বৃদ্ধি হয়নি।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় লর্ড কর্নওয়ালিশ প্রবর্তিত ১৭৯৩ সালের যে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করেন তা ছিল অনেকটাই যুগোপযোগী ও জনকল্যাণমুখী। এই ব্যবস্থার ফলে ভূমি রাজস্বে স্থিতিশীলতা আসে। তবে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে কিছু অসুবিধা তথা কুফলও বিদ্যমান ছিল। যার ফলে এই ব্যবস্থা সরকারকে শতভাগ সফলতা দিতে পারেনি।