গ' বিভাগ
বাংলার ইতিহাস। অনার্স তৃতীয় বর্ষ।
অজকের আলোচনা, ফরায়েজী আন্দোলনে হাজী শরীয়তুল্লাহর অবদান৷
ফরায়েজী আন্দোলন। |
প্রশ্নঃ ফরায়েজী আন্দোলনে হাজী শরীয়তুল্লাহর অবদান মূল্যায়ন কর৷
উত্তর: ভূমিকা: অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে সিরাজউদ্দৌলার পতনের পর ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমানরা এক চরম অস্তিত্ব সংকটে পড়ে। ধর্মীয় ও সামাজিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন কুসংস্কার এবং কুপ্রথা তাদের জীবন দুর্বিষহ করে তোলে। মৌলিক ধর্মীয় অনুশাসন পালনে মুসলমানদের নানা বাধার সম্মুখীন হতে হয়। এই দুঃসহ পরিস্থিতি থেকে মুক্তি এবং ধর্মীয় অনুশাসন পালনের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হাজী শরীয়ুতল্লাহ ১৮১৮ সালে একটি বিশাল আন্দোলনের সূচনা করেন, যা ইতিহাসে ফরায়েজী আন্দোলন নামে পরিচিত। প্রথমে এটি একটি ধর্মীয় আন্দোলন হিসেবে শুরু হলেও পরবর্তীতে এটি সামাজিক ও রাজনৈতিক রূপ লাভ করে। হাজী শরীয়ুতল্লাহর ফরায়েজী আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ দিকসমূহ নিচে আলোচনা করা হলো।
হাজী শরীয়তুল্লাহর পরিচিতি: ফরায়েজী আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা হাজী শরীয়তুল্লাহ ১৭৮১ সালে ফরিদপুর জেলার মাদারীপুর মহকুমার শ্যামায়েল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। মাত্র আট বছর বয়সে পিতৃবিয়োগের কারণে শৈশবে পড়াশোনা করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন। ১৭৯৯ সালে হজ পালনের উদ্দেশ্যে মক্কায় গমন করেন এবং ১৮১৮ সালে দেশে ফিরে আসেন। কিছু মত অনুযায়ী, তিনি দ্বিতীয়বার হজে গিয়ে ১৮২৮ সালে দেশে ফিরে আসেন। মক্কায় অবস্থানকালে তিনি সম্বাল নামক একজন বিখ্যাত আইনশাস্ত্রবিদের কাছে ধর্মীয় জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় চৌদ্দ বছর অধ্যয়ন করেন। এই সময় তিনি ওহাবী আন্দোলনের প্রভাবেও আসেন। দেশে ফিরে তিনি মুসলিম সমাজে প্রচলিত বিভিন্ন কুসংস্কার ও কুপ্রথার বিরুদ্ধে সচেতনতা সৃষ্টিতে উদ্যোগী হন এবং ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কারের লক্ষ্যে আন্দোলন গড়ে তোলেন।
ফরায়েজী আন্দোলনে হাজী শরীয়তুল্লাহর অবদান: ফরায়েজী আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী হাজী শরীয়তুল্লাহ ছিলেন একজন দূরদর্শী সমাজসংস্কারক। তিনি তৎকালীন ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমানদের মধ্যে প্রচলিত সকল কুসংস্কার ও ভ্রান্ত প্রথার বিরুদ্ধে সংগ্রামে নেতৃত্ব দেন। তার অবদানের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক নিচে আলোচনা করা হলো:
(ক) মুসলিম সমাজে প্রচলিত কুসংস্কার দূরীকরণ: হাজী শরীয়তুল্লাহ মুসলমানদের বিভিন্ন কুসংস্কার এবং ভ্রান্ত বিশ্বাস দূর করতে কঠোর ভূমিকা পালন করেন। তিনি এক আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আনুগত্য করার শিক্ষা দেন এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে সিজদা করাকে শিরক হিসেবে ঘোষণা করেন। মহরমে শোক পালন, গাজী কালুর প্রশস্তি গাওয়া, জন্মদিনে ছুটি পালন ইত্যাদিকে তিনি বিদআত বলে নিন্দা করেন। এ ছাড়াও, তিনি রাসূল (সা.)-কে একমাত্র আদর্শ হিসেবে অনুসরণ করার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন।
(খ) সাবেকীদের বিরোধিতার জবাব: ফরায়েজী আন্দোলনের বিরুদ্ধে তৎকালীন সময় মাওলানা শাহ কেরামত আলী জৌনপুরীর অনুসারীদের একটি দল সক্রিয় বিরোধিতা করে। এ দলটি ফরায়েজী আন্দোলনের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলে যে, তারা ইসলামের প্রকৃত নীতিমালা ধ্বংস করতে চায়। তারা বাংলা অঞ্চলকে "দার-উল-আমান" বা নিরাপত্তার দেশ বলে অভিহিত করে দাবি করে যে এখানে জিহাদ চালানোর প্রয়োজন নেই। তবে, হাজী শরীয়তুল্লাহ তাদের সকল অভিযোগের যুক্তিসঙ্গত ও বস্তুনিষ্ঠ জবাব দিয়ে তার আন্দোলন চালিয়ে যান। তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়ে দেন যে, তার আন্দোলন ইসলামের ভিত্তি পুনর্গঠনে এবং মুসলিম সমাজে কুসংস্কার ও ভ্রান্তি দূর করার জন্য পরিচালিত। এই যুক্তিপূর্ণ নেতৃত্বই তার আন্দোলনকে সফল ও স্থায়িত্বশীল করতে সহায়তা করে।
(গ) জমিদার ও নীলকরদের বিরোধিতা: তৎকালীন উপমহাদেশে কিছু অত্যাচারী জমিদার ও নীলকর মুসলমানদের উপর অন্যায়ভাবে কর আরোপ করত এবং শোষণের মাধ্যমে তাদের জীবনে দুর্বিষহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করত। এরা সরাসরি ইংরেজদের সমর্থনপুষ্ট থাকায় এদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া ছিল অত্যন্ত কঠিন। তবে হাজী শরীয়তুল্লাহ অন্যায়ের বিরুদ্ধে কখনো আপস করেননি। তিনি জমিদার ও নীলকরদের শোষণের বিরুদ্ধে মুসলমানদের সংগঠিত করে তাদের অধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলন চালিয়ে যান। তার নেতৃত্বে শোষিত জনগণ সচেতন হয় এবং সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে শেখে। এটি তার আন্দোলনের সামাজিক ও রাজনৈতিক গুরুত্বকে আরও বৃদ্ধি করে।
(ঘ) লাঠিয়াল বাহিনী গঠন: ইংরেজদের পৃষ্ঠপোষকতায় কিছু হিন্দু জমিদার মুসলমানদের ওপর নিপীড়ন চালিয়ে অন্যায়ভাবে কর আদায় শুরু করে। এই অন্যায় শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে জমিদারদের সাথে হাজী শরীয়তুল্লাহর বিরোধ চরম আকার ধারণ করে। পরিস্থিতি সামাল দিতে এবং জমিদারদের প্রতিরোধ করার জন্য তিনি ১৮৩১ সালে একটি লাঠিয়াল বাহিনী গঠন করেন। এ বাহিনী ছিল সংগঠিত ও সাহসী মুসলমানদের দ্বারা পরিচালিত, যারা ন্যায়বিচারের জন্য সংগ্রাম করত। এই পদক্ষেপ তার আন্দোলনে এক দৃঢ় শক্তি যোগায় এবং মুসলমানদের ঐক্য ও আত্মরক্ষার জন্য একটি কার্যকর দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠে।
(ঙ) শরীয়তবিরোধী কার্যকলাপ নিষিদ্ধ ঘোষণা: হাজী শরীয়তুল্লাহ মুসলমানদের মধ্যে প্রচলিত বিভিন্ন কুসংস্কার, শিরক, ও বিদআতকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন এবং ইসলামের শুদ্ধ ধারণা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করেন। তার ঘোষিত গুরুত্বপূর্ণ নিষিদ্ধ কার্যাবলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য:
(i) তিনি মুসলমানদের মধ্যে প্রচলিত “পীর” ও “মুরিদ” ধারণার বিরোধিতা করেন। তার মতে, এই শব্দগুলো মানুষকে বিভ্রান্ত করে, তাই তিনি এগুলোর পরিবর্তে “ওস্তাদ” ও “ছাত্র” শব্দ ব্যবহারের পরামর্শ দেন।
(ii) তিনি কালীপূজা, লক্ষ্মীপূজা, পীর পূজা ইত্যাদি শিরকী কাজকে সম্পূর্ণ হারাম ও ইসলামবিরোধী হিসেবে আখ্যায়িত করেন এবং মুসলমানদের এ থেকে দূরে থাকার আহ্বান জানান।
(iii) মহরমের শোকে উচ্ছ্বাসিত হয়ে বিভিন্ন ধরনের কর্মকাণ্ডকে বিদআত বলে ঘোষণা করেন।
(iv) মুসলমানদের বিবাহ অনুষ্ঠানকে হিন্দু রীতিনীতির প্রভাবমুক্ত করার জন্য তিনি এসব প্রথা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন।
এই সংস্কারমূলক উদ্যোগগুলোর মাধ্যমে তিনি মুসলিম সমাজে ধর্মীয় শুদ্ধতা ও সামাজিক শৃঙ্খলা আনয়নে ভূমিকা রাখেন।
(চ) আঞ্চলিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা: হাজী শরীয়তুল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে হাজার হাজার মানুষ তার আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়। এ বিশাল সংখ্যক অনুসারীদের কার্যক্রম সুসংগঠিত করতে তিনি আঞ্চলিক সংগঠন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৮৩৮ সালে তিনি ঢাকা, পাবনা, ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন অঞ্চলে আঞ্চলিক সংগঠন গড়ে তোলেন। এই সংগঠনগুলো তার আন্দোলনকে তৃণমূল পর্যায়ে ছড়িয়ে দিতে এবং সাধারণ জনগণকে সংঘবদ্ধ করে শোষণ, কুসংস্কার, ও সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে সাহায্য করে। তার এই সংগঠনগুলোর মাধ্যমে ফরায়েজী আন্দোলন আরও শক্তিশালী ও কার্যকর হয়ে ওঠে।
(ছ) বাংলাকে দারুল হারব ঘোষণা: তৎকালীন সময়ে ইংরেজ শাসনের অত্যাচার এবং তাদের মদদপুষ্ট জমিদার ও নীলকরদের শোষণের কারণে বাংলার পরিবেশ চরম অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। মুসলমানরা সামাজিক, অর্থনৈতিক, ও ধর্মীয়ভাবে নিপীড়িত হয়ে নিজেদের অস্তিত্ব সংকটে ভুগছিল। এই পরিস্থিতি বিবেচনা করে হাজী শরীয়তুল্লাহ বাংলাকে "দারুল হারব" বা বিধর্মী শাসিত দেশ হিসেবে ঘোষণা করেন। তিনি যুক্তি দেন যে, এখানে ইসলামি শাসন ব্যবস্থা বিদ্যমান না থাকায় এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা লঙ্ঘিত হওয়ায় জিহাদ করা ফরজ। তার এই ঘোষণা মুসলমানদের মধ্যে প্রতিরোধের চেতনা জাগ্রত করে এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামে সাহস জোগায়।
(জ) ইংরেজবিরোধীতা: হাজী শরীয়তুল্লাহ শুধু ধর্মীয় সংস্কারে সীমাবদ্ধ থাকেননি; বরং তিনি ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে পরোক্ষভাবে সাধারণ মানুষের মধ্যে বৃটিশবিরোধী মনোভাব জাগ্রত করেন। তিনি বাংলাকে "দারুল হারব" বা বিধর্মীদের দ্বারা শাসিত দেশ হিসেবে ঘোষণা করেন এবং এর ফলে জুমা ও ঈদের নামাজ নিষিদ্ধ করেন, কারণ ইসলামের বিধান অনুযায়ী, এসব নামাজ দারুল ইসলাম বা ইসলামি রাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত হতে পারে। তার এই পদক্ষেপ ইংরেজ শাসনের প্রতি মানুষের অসন্তোষ বৃদ্ধি করে এবং শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
(ঝ) রাজনৈতিক চেতনা সৃষ্টি: ফরায়েজী আন্দোলনের মাধ্যমে হাজী শরীয়তুল্লাহ তার অনুসারীদের মাঝে একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক চেতনা সৃষ্টির ক্ষেত্র প্রস্তুত করেন। তার বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক কার্যক্রমের ফলস্বরূপ মুসলমানদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা বাড়তে থাকে। তিনি ইংরেজ শাসনকে নিপীড়নমূলক এবং ইসলাম বিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে একটি বিদ্বেষ ও প্রতিরোধের মনোভাব সৃষ্টি করেন। এর মাধ্যমে এদেশের মানুষের মধ্যে ইংরেজদের প্রতি শত্রুতা এবং তাদের শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে অংশগ্রহণ করার প্রবণতা তৈরি হয়। ফলে পরবর্তী সময়ে যে কোনো ইংরেজবিরোধী আন্দোলনে এদেশের মুসলমানরা বিশাল সংখ্যায় যোগ দেয়, যা স্বাধীনতার সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।
(ঞ) ঐক্য প্রতিষ্ঠা: ফরায়েজী আন্দোলনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অবদান হল হাজী শরীয়তুল্লাহর নেতৃত্বে ভিন্ন ভিন্ন মতাদর্শের মানুষকে একসূত্রে গাঁথা। তিনি তার সমর্থকদের মধ্যে একটি শক্তিশালী ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন এবং তাদের একই মূলমন্ত্রে দীক্ষিত করে ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কারের আন্দোলনে যুক্ত করেন। তার প্রতিষ্ঠিত আঞ্চলিক সংগঠনগুলো বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি বৃহত্তর আন্দোলনে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। এই ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা আন্দোলনকে শক্তিশালী ও সুসংহত করে, যা পরে সমাজে ইসলামী আদর্শ প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হয়।
উপসংহার: হাজী শরীয়তুল্লাহ ছিলেন একজন অমায়িক ও শান্তিপ্রিয় নেতা, যার অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ও কার্যকলাপ লোকজনকে তার আন্দোলনে অংশগ্রহণে অনুপ্রাণিত করেছিল। তিনি শিক্ষাদানের মাধ্যমে প্রশিক্ষিত লাঠিয়াল বাহিনী গঠন করেন এবং মুসলমানদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখেন। ইংরেজ শাসন, জমিদার ও নীলকরদের বিরুদ্ধে তার নেতৃত্বে প্রাথমিক প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। ১৮৪০ সালে তার মৃত্যু হলে, তার পুত্র দুদু মিয়া আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন।