গ' বিভাগ
দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস। অনার্স তৃতীয় বর্ষ।
আজকের আলোচনা, ১৭৬৫-১৭৯৩ পর্যন্ত দক্ষিণ এশিয়ার ইস্টই ন্ডিয়া কোম্পানির ভূমি রাজস্ব নীতির বিশ্লেষণ।
প্রশ্নঃ ১৭৬৫-১৭৯৩ পর্যন্ত দক্ষিণ এশিয়ার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভূমি রাজস্ব নীতি বিশ্লেষণ কর।
অথবা, ১৭৬৫-১৭৯৩ পর্যন্ত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভূমি রাজস্ব নীতি বিশ্লেষণ কর।
অথবা, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক ভূমি রাজস্ব নীতির বিশ্লেষণ কর।
উত্তর: ভূমিকা: মুঘল সম্রাটের শাসনামলে ভারতে আগমনকারী ব্রিটিশরা এদেশে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য নিয়ে আসলেও ১৭৫৭ সালের পলাশির যুদ্ধ এবং ১৭৬৪ সালের বক্সারের যুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমে তারা বাংলার ক্ষমতা দখল করে। এরপর, ১৭৬৫ সালে কোম্পানি দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা চালু করে এবং ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন করে। শুরুতে পঞ্চসালা ও দশসালা ব্যবস্থাও চালু করে, যা কৃষকদের অবস্থাকে আরও খারাপ করে দেয়। অন্যদিকে, ব্রিটিশ কোম্পানি ভারতে শোষণমূলক শাসন ব্যবস্থা পরিচালনা করতে থাকে। এতে বাংলার মানুষের সাথে ইংরেজদের সরকারের সম্পর্কের অবনতি ঘটতে থাকে। ইংরেজি এই সমস্যার সমাধান করার জন্য বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা প্রবর্তন করে।
দক্ষিণ এশিয়ায় (১৭৬৫-৯৩) ব্রিটিশদের ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা: পলাশির যুদ্ধ এবং বক্সারের যুদ্ধে বিজয়ের পর ব্রিটিশরা ভারতের শাসন পরিচালনার ক্ষেত্রে স্থানীয় শাসকদের সামনে রাখলেও সব নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নেয়। তারা প্রশাসনের পাশাপাশি ভূমি ব্যবস্থাকেও নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনে। নিচে এই বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হলো।
পঞ্চসালা বন্দোবস্ত: পঞ্চসালা বন্দোবস্ত ছিল ব্রিটিশদের ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা পুনর্গঠনের একটি পরীক্ষামূলক প্রয়াস। ওয়ারেন হেস্টিংস ক্ষমতায় এসে পূর্বের রাজস্ব ব্যবস্থা বাতিল করেন এবং নায়েব-নাজিমদের বরখাস্ত করে রাজস্ব সংগ্রহের দায়িত্ব কালেক্টরদের হাতে দেন। এই কালেক্টরগণ জমিদারদের সাথে সরাসরি আলোচনার মাধ্যমে পাঁচ বছরের জন্য জমির ইজারা বা বন্দোবস্ত করতেন।
পঞ্চসালা বন্দোবস্তের প্রেক্ষাপট: ১৭৬৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মুঘল সম্রাটের কাছ থেকে দেওয়ানির অধিকার লাভ করে, যার ফলে তারা ভারতীয় কৃষকদের উপর কঠোর কর ব্যবস্থা প্রয়োগ করে। এই জোরপূর্বক কর আরোপের কারণে দরিদ্র কৃষকরা জমি হারিয়ে গৃহহীন হয়ে পড়ে। এর প্রভাব পড়ে বাংলার অর্থনীতিতে এবং ১১৭৬ বঙ্গাব্দে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর নামে খ্যাত ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সৃষ্টি হয়। দুর্ভিক্ষ ও কর ব্যবস্থার ব্যর্থতা দ্বৈতশাসনকেও অকার্যকর প্রমাণ করে। এই পরিস্থিতিতে ব্রিটিশরা দেওয়ানি পদ্ধতি বাতিল করে পঞ্চসালা বন্দোবস্ত চালু করে, তবে সেটিও সফল হতে পারেনি।
পঞ্চসালা বন্দোবস্তের বৈশিষ্ট্য: ওয়ারেন হেস্টিংসের প্রবর্তিত পাঠশালা বন্দোবস্তের বৈশিষ্ট্যসমূহ তুলে ধরা হলো।
(i) বন্দোবস্তের মেয়াদ পাঁচ বছর ১৯ এপ্রিল ১৭৭২ থেকে ১০ এপ্রিল ১৭৭৭ সাল পর্যন্ত ।
(ii) ইজারা জমি গঠিত হবে পুরো পরগণা নিয়ে এবং এর সরকারি জমা হবে সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা ।
(iii) ইজারাদের সাথে শর্তাদি সম্বলিত চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে; ইজারাদারও অনুরূপভাবে শর্তাদি উল্লেখ করে রায়তকে পাট্টা দিবে। পাট্টায় দখলিকৃত জমির পরিমাণ ও খাজনার উল্লিখিত হার থাকবে।
(iv) পাট্টায় অনুল্লিখিত সমস্ত আবওয়ার বা বিবিধ কর আদায় অবৈধ হবে।
(v) নজর, সেলামি প্রভৃতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হবে।
(vi) জেলা কালেক্টর সব উক্ত সব নীতিমালা সর্বত্র ঘোষণা করবেন এবং ইজারা গ্রহণে আগ্রহী প্রার্থীদের থেকে নিলাম ডাক আহ্বান করবেন ।
(vii) কালেক্টর একটি পরগণাওয়ারী হস্তবুদ তৈরি রাখবেন। ঐ হস্তবুদের নিরিখে কমিটি নিলাম পরিচালনা করবে।
পঞ্চসালা বন্দোবস্তের ফলাফল: পঞ্চসালা বন্দোবস্ত থেকে সুফল পাওয়ার আশায় কোর্ট অব ডাইরেক্টরস ১৭৭৪ সালের ২৪ মার্চ এটি অনুমোদন করে। কিন্তু কার্যকর করার পর থেকেই বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হয়। বেশিরভাগ ইজারাদার শর্ত অনুযায়ী রাজস্ব পরিশোধে ব্যর্থ হয়। এর পাশাপাশি ১৭৬৯-৭০ সালে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ বাংলার কৃষি ও অর্থনীতিকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ফলে পঞ্চসালা বন্দোবস্ত কার্যকরভাবে ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থাকে উন্নত করতে ব্যর্থ হয়।
দশসালা বন্দোবস্ত (১৭৯০): পিটের ভারত শাসন আইন, ১৭৮৪-এর নির্দেশনা অনুযায়ী কলকাতা সরকারকে রাজস্ব ব্যবস্থায় পরীক্ষামূলক পরিবর্তন বন্ধ করতে বলা হয়। একই সঙ্গে জমিদার এবং সরকারের জন্য সুবিধাজনক একটি দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থা চালু করার ওপর জোর দেওয়া হয়। এই উদ্দেশ্যে, লর্ড কর্নওয়ালিসকে ১৭৮৬ সালে গভর্নর জেনারেল হিসেবে ভারতে পাঠানো হয়। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালুর আগে এর কার্যকারিতা মূল্যায়নের জন্য ১৭৯০ সালে একটি পরীক্ষামূলক বন্দোবস্ত প্রণয়ন করা হয়, যা দশসালা বন্দোবস্ত নামে পরিচিত।
দশসালা বন্দোবস্তের বৈশিষ্ট্য: দশসালা বন্দোবস্তে জমি ইজারার মেয়াদ ছিল ১০ বছর। এ ব্যবস্থায় রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে সরকারের লক্ষ্য ছিল চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মূলনীতিগুলো পর্যালোচনা করা। এ ব্যবস্থা অনুযায়ী জমিদারদের সাথে সরাসরি চুক্তি করে রাজস্ব আদায়ের কার্যক্রম পরিচালিত হতো। জমিদারদের কাছ থেকে কর সংগ্রহের পরিবর্তে কৃষকদের কাছ থেকে কর আদায়ের কাজ জমিদারদের উপর অর্পণ করা হয়।
দশসালা বন্দোবস্তের ফলাফল: দশসালা বন্দোবস্তের ভিত্তিতেই ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু করা হয়। পরীক্ষামূলক হলেও এই বন্দোবস্তে কৃষকরা শোষণের শিকার হয়, কারণ জমিদাররা অধিক লাভের জন্য তাদের উপর চরম চাপ প্রয়োগ করত। তবুও এই ব্যবস্থাটি ব্রিটিশ শাসকদের দীর্ঘমেয়াদি শাসন প্রতিষ্ঠার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হয়ে ওঠে।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত (১৭৯৩): চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হলো ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ, যা ১৭৯৩ সালের ২২ মার্চ গভর্নর জেনারেল লর্ড কর্নওয়ালিস কর্তৃক চালু করা হয়। তবে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ধারণাটি নতুন ছিল না; এটি নিয়ে প্রায় দুই দশক আগে থেকেই বিভিন্ন মহলে আলোচনা চলছিল।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রেক্ষাপট: ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন করা হলেও এর ধারণা অনেক আগে থেকেই চলে আসছিল। তবে বিভিন্ন প্রতিকূল পরিবেশ ও বাধার কারণে এটি প্রবর্তন করা সম্ভাব হচ্ছিল না। নিম্নে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রেক্ষাপট তুলে ধরা হলো।
প্রথম ধারণা: চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের আইডিয়া প্রাথমিকভাবে আলেকজান্ডার দাও ও হেনরি পেটুল্লোর মাধ্যমে আসে, যা পরে কাউন্সিলর ফিলিপ ফ্রান্সিস কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয়। যদিও ফিলিপ ফ্রান্সিসের প্রস্তাবিত বন্দোবস্ত কার্যকর হয়নি, তবুও এটি ব্রিটিশদের রাজস্ব ব্যবস্থার দিকে নির্দেশনা প্রদান করে।
পিটের ভারত আইন (১৭৮৪): এই আইনের ৩৯ ধারা রাজস্ব ব্যবস্থার ওপর বিশেষ দিক নির্দেশনা প্রদান করে। যা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের ক্ষেত্রে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
দশ শালা বন্দোবস্ত: লর্ড কর্নওয়ালিসকে ১৭৮৬ সালে কোর্ট অব ডাইরেক্টরস দ্বারা গভর্নর জেনারেল হিসেবে ভারতে পাঠানো হয় রাজস্ব সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যে। কিন্তু রাজস্ব উপদেষ্টা জন শোরের মতানৈক্য চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বাস্তবায়নে বিলম্ব ঘটায়। জন শোর দশসালা বন্দোবস্ত চালুর পক্ষে মত দেন, যা পরীক্ষামূলক পদক্ষেপ হিসেবে কাজ করে।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বৈশিষ্ট্য: লর্ড কর্নওয়ালিসের প্রবর্তিত পাঠশালা বন্দোবস্তের বৈশিষ্ট্যসমূহ তুলে ধরা হলো।
i. জমিদাররা জমি ইজারার জন্য নির্ধারিত স্থায়ী কর প্রদান করতেন।
ii. জমির মালিকানার দায়িত্ব এবং রাজস্ব সংগ্রহের ভার জমিদারদের হাতে তুলে দেওয়া হয়।
iii. কৃষকদের কাছ থেকে কর আদায়ের দায়িত্ব জমিদারদের ওপর ন্যস্ত করা হয়।
iv. সরকার ও জমিদার উভয়ের মধ্যে একটি চিরস্থায়ী চুক্তি স্থাপন করা হয়।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলাফল: চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ব্রিটিশ সরকাকে একটি স্থিতিশীল রাজস্ব আয় নিশ্চিত করে, যা কোম্পানি রাজস্ব ব্যবস্থা কেন শক্তিশালী করে। এ ব্যবস্থায় জমিদারদের সম্পদের অধিকার বৃদ্ধি পেলেও রায়তদের শোষণের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। জমিদারদের উদাসীনতার কারণে কৃষি উন্নতি বাধাগ্রস্ত হয়।
উপসংহার: ইংরেজরা নিজেদের স্বার্থে ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থায় বিভিন্ন পরিবর্তন আনে। ১৭৬৫ সালে দেওয়ানি শাসন থেকে শুরু করে পঞ্চসালা, দশসালা ও ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন করে। সূর্যাস্ত আইনসহ কঠোর রাজস্ব নীতির ফলে দরিদ্র কৃষকরা শোষণের শিকার হয়ে জমি-জমা হারিয়ে চরম দারিদ্র্যের মুখে পড়ে। এর ফলস্বরূপ বাংলায় মহা দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় এবং গ্রামীণ সমাজে হতাশা ও বিপর্যয় নেমে আসে।
ধন্যবাদ
উত্তরমুছুন