ইতিহাসের সংজ্ঞা ও ইতিহাসের প্রধান বৈশিষ্ট্য।

স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস। 

আজকের আলোচনা, ইতিহাসের সংজ্ঞা ও ইতিহাসের প্রধান বৈশিষ্ট্য। 

ইতিহাসের সংজ্ঞা ও ইতিহাসের প্রধান বৈশিষ্ট্য
ইতিহাসের সংজ্ঞা ও এর প্রধান বৈশিষ্ট্য


ইতিহাসের সংজ্ঞা ও ইতিহাসের প্রধান বৈশিষ্ট্য। 

মানবসভ্যতার ইতিহাস হাজার বছরের বিস্তৃত একটি জ্ঞানের ভাণ্ডার। "ইতিহাস" শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ Historia থেকে, যার অর্থ হলো অনুসন্ধান বা জানার চেষ্টা। ইতিহাসের মাধ্যমে মানুষ তার অতীত সম্পর্কে জানে, বর্তমানকে উপলব্ধি করে এবং ভবিষ্যতের জন্য সঠিক পথনির্দেশ পায়। ইতিহাস কেবল রাজা-বাদশাহ, যুদ্ধ বা রাজনীতির কাহিনী নয়; বরং এটি মানবসমাজের সকল দিক—সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক—একটি পূর্ণাঙ্গ বিবরণ



ইতিহাসের সংজ্ঞা

ইতিহাস মানুষের অতীত জীবন, সমাজ, রাষ্ট্র ও সভ্যতার ধারাবাহিক বিবরণ। এটি কেবল ঘটনাবলীর তথ্যভিত্তিক রেকর্ড নয়, বরং সেই ঘটনাগুলোর কারণ, প্রভাব ও তাৎপর্যের বিশ্লেষণ ও ইতিহাসের অন্তর্ভুক্ত। ভিন্ন ভিন্ন মনীষী ইতিহাসকে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে সংজ্ঞায়িত করেছেন।

অ্যারিস্টটল মনে করতেন, “ইতিহাস হলো অতীত ঘটনার সত্যনিষ্ঠ বিবরণ।” অর্থাৎ ইতিহাসের কাজ হলো যেসব ঘটনা ঘটেছে তা বাস্তব তথ্য ও দলিলের ভিত্তিতে উপস্থাপন করা।
সিসেরো বলেছেন, “ইতিহাস হলো সময়ের সাক্ষ্য, সত্যের আলো, স্মৃতির প্রাণ এবং জীবনের শিক্ষক।” তার দৃষ্টিতে ইতিহাস শুধু অতীতের রেকর্ড নয়, বরং ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষা।
ভলতেয়ার এর মতে, “ইতিহাস হলো অতীত ঘটনার সেই বিবরণ যা জাতিকে জ্ঞানী করে তোলে।” তিনি ইতিহাসকে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার উৎস হিসেবে দেখেছেন।
লর্ড অ্যাক্টন এর দৃষ্টিতে, “ইতিহাস হলো স্বাধীনতার সংগ্রামের কাহিনি।” অর্থাৎ ইতিহাস মানুষের স্বাধীনতা অর্জনের ধারাবাহিক প্রচেষ্টার সাক্ষ্য।

এই সংজ্ঞাগুলোর বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, ইতিহাস কেবল অতীতের ঘটনা নয়; বরং তা মানবসমাজের ক্রমবিকাশের দলিল, শিক্ষা ও অনুপ্রেরণার উৎস, এবং জাতির পরিচয়ের ভিত্তি। ইতিহাস মানুষকে তার অতীত সম্পর্কে অবগত করে, ভবিষ্যতের জন্য পথ নির্দেশ করে এবং বর্তমানকে মূল্যায়নের মানদণ্ড গড়ে তোলে।



ইতিহাসের বৈশিষ্ট্য

ইতিহাসকে একটি বিজ্ঞানের শাখা হিসেবে ধরা হয়, কারণ এটি তথ্য-প্রমাণ, দলিলপত্র ও গবেষণার উপর নির্ভরশীল। এর মূল উদ্দেশ্য হলো অতীতের ঘটনাকে সঠিকভাবে অনুসন্ধান, বিশ্লেষণ ও উপস্থাপন করা। নিচে ইতিহাসের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা করা হলো।

১. তথ্যনির্ভরতা

ইতিহাস মূলত তথ্যভিত্তিক বিদ্যা। কোনো কাহিনী, কিংবদন্তি বা কল্পকাহিনী ইতিহাস নয়, যতক্ষণ না তা নির্ভরযোগ্য দলিল, শিলালিপি, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, পুঁথি, সরকারি নথি বা প্রত্যক্ষ বিবরণের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়।

২. অনুসন্ধানমূলক

ইতিহাস গবেষক বা ইতিহাসবিদকে সর্বদা অনুসন্ধিৎসু হতে হয়। নতুন নতুন প্রমাণ, দলিল, নিদর্শন ও গবেষণা পদ্ধতি আবিষ্কার হলে ইতিহাসের ব্যাখ্যা পরিবর্তিত হতে পারে।

৩. আত্মপলব্ধিমূলক

ইতিহাস মানুষকে তার অস্তিত্ব ও শিকড় সম্পর্কে আত্মপলব্ধি করায়। জাতি, দেশ ও সভ্যতার অতীত জানার মাধ্যমে মানুষ নিজেকে বোঝে এবং ভবিষ্যতের জন্য সঠিক দিকনির্দেশনা খুঁজে পায়।

৪. সর্বজনীনতা

ইতিহাস কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর সম্পত্তি নয়। এটি সর্বজনীন। প্রত্যেক জাতি ও সভ্যতারই নিজস্ব ইতিহাস আছে, যা পৃথিবীর সামগ্রিক ইতিহাসের অংশ হয়ে ওঠে।

৫. নিরপেক্ষতা

ইতিহাসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো নিরপেক্ষতা। ইতিহাসবিদকে নিজের আবেগ, মতাদর্শ ও রাজনৈতিক ঝোঁক থেকে মুক্ত থেকে কেবল তথ্য ও প্রমাণের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত দিতে হয়।


৬. ধারাবাহিকতা

ইতিহাস একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। এর কোনো বিচ্ছিন্নতা নেই। প্রতিটি ঘটনা পূর্ববর্তী ঘটনার সাথে সম্পর্কিত এবং ভবিষ্যতের ঘটনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

৭. সঠিকত্ব

সত্যতা ও সঠিক উপস্থাপন ইতিহাসের প্রাণ। ইতিহাসের সামান্য ভ্রান্তিও পরবর্তী প্রজন্মকে ভুল পথে পরিচালিত করতে পারে। তাই ইতিহাসবিদেরা তথ্য যাচাই করে তবেই সিদ্ধান্ত দেন।

৮. পরিবর্তনশীলতা

ইতিহাস অপরিবর্তনীয় নয়। নতুন তথ্য প্রমাণের আলোকে কোনো ঘটনার নতুন ব্যাখ্যা হাজির হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা অনেক অজানা তথ্য উন্মোচন করেছে।

৯. মানবজাতির ক্রমবিকাশের বিবরণ

ইতিহাস মানবজাতির ক্রমবিকাশের ধারাবাহিক চিত্র মানুষ কীভাবে গুহায় বাস থেকে আধুনিক প্রযুক্তি সমাজে এসেছে—তার বিবরণই ইতিহাস দেয়।

১০. অতীতের তথ্য বিবরণী

ইতিহাস কেবল বর্তমান নয়, বরং অতীতের ঘটনা, তার কারণ, ফলাফল ও শিক্ষাকে বিশ্লেষণ করে।

১১. নৈতিক মূল্যবোধ জাগ্রত করে

ইতিহাস নৈতিকতা শিক্ষা দেয়। বীরত্ব, আত্মত্যাগ, সততা, ন্যায়বিচার—এসব মূল্যবোধ ইতিহাস থেকে শেখা যায়।

১২. বিবর্তন ও বিবর্তনবাদের বিবরণ

মানবসভ্যতা, সমাজব্যবস্থা, রাজনীতি, ধর্ম, সাহিত্য, সংস্কৃতি—সব কিছুর বিবর্তন প্রক্রিয়া ইতিহাসে লিপিবদ্ধ থাকে।

১৩. দেশপ্রেম জাগ্রত করে

জাতির ইতিহাস মানুষকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে। স্বাধীনতার আন্দোলন, বীর শহীদদের ত্যাগ, মহান নেতাদের সংগ্রাম জানলে মানুষ নিজের মাতৃভূমির প্রতি গভীর ভালোবাসা অনুভব করে।

১৪. আবেগ বর্জিত উন্মেষ

ইতিহাসকে আবেগমুক্তভাবে উপস্থাপন করতে হয়। ব্যক্তিগত মতামত বা পক্ষপাতিত্ব থাকলে ইতিহাস বিকৃত হয়।

১৫. বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার মহান আদর্শের সাথে পরিচয়

ইতিহাস মানুষকে যুদ্ধের ভয়াবহতা ও শান্তির গুরুত্ব শেখায়। অতীতের যুদ্ধ ও সংঘাত থেকে শিক্ষা নিয়ে মানবজাতি বিশ্বশান্তির দিকে অগ্রসর হয়।



সারসংক্ষেপে বলা যায়,  ইতিহাস হলো মানবসমাজের আয়না। এর মাধ্যমে মানুষ অতীতকে জানে, বর্তমানকে বোঝে এবং ভবিষ্যতের পথ খুঁজে নেয়। তথ্যনির্ভরতা, নিরপেক্ষতা, ধারাবাহিকতা, নৈতিক মূল্যবোধ ও বিশ্বশান্তি—এসব ইতিহাসের প্রধান বৈশিষ্ট্য। তাই সঠিক ও নিরপেক্ষ ইতিহাস রচনা মানবজাতির অগ্রগতির জন্য অপরিহার্য।

5 মন্তব্যসমূহ

নবীনতর পূর্বতন