স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস
আজকের আলোচনা , আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা কারণ ও ফলাফল।
![]() |
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা |
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা কারণ ও ফলাফল
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই মামলার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাঙালি জাতীয়তাবাদকে দমন করতে চাইলেও উল্টো তা আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য নেতাদের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার অভিযোগ এনে পাকিস্তানি শাসকরা চেষ্টা করেছিল বাঙালি মুক্তিসংগ্রামকে স্তব্ধ করে দিতে। কিন্তু এই ষড়যন্ত্র মামলাই শেষ পর্যন্ত জাতীয় আন্দোলনের মোড় ঘুরিয়ে দেয় এবং স্বাধীনতার সংগ্রামকে আরও গতিশীল করে তোলে। নিচে এই মামলার প্রেক্ষাপট, কারণ, ফলাফল ও তাৎপর্য আলোচনা করা হলো।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার পটভূমি
১. ভাষা আন্দোলনের প্রভাব
২. ছয় দফা কর্মসূচি
৩. রাজনৈতিক অস্থিরতা
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ঘটনা
আগরতলা মামলার কারণ
১. ষড়যন্ত্রের অভিযোগ
১৯৬৮ সালের জানুয়ারিতে পাকিস্তান সরকার একটি মামলা দায়ের করে। অভিযোগ ছিল, শেখ মুজিবুর রহমানসহ একদল বাঙালি নেতা ভারতের আগরতলায় গিয়ে ষড়যন্ত্র করে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করার পরিকল্পনা করেছে।
২. সরকারের উদ্দেশ্য
- বাঙালি জাতীয়তাবাদকে দমন করা।
- শেখ মুজিবকে রাজনৈতিকভাবে নিস্ক্রিয় করা।
- জনগণকে ভয় দেখিয়ে আন্দোলন দমন করা।
৩. বাঙালি জাতীয়তাবাদকে দমন করা
শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর ছয় দফা পাকিস্তানি শাসকদের কাছে হুমকি ছিল। তাই তাঁকে রাষ্ট্রদ্রোহী প্রমাণ করে রাজনৈতিকভাবে অকার্যকর করার পরিকল্পনা করা হয়।
৪. রাজনৈতিক নেতৃত্ব ধ্বংসের চেষ্টা
আওয়ামী লীগ তখন পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান রাজনৈতিক শক্তি। এই শক্তিকে ভেঙে দিতে এবং জনসমর্থনকে দমন করতে মুজিবসহ অন্যান্য নেতাদের ফাঁসানোর ষড়যন্ত্র করা হয়।
৫. সামরিক শাসনের বৈধতা প্রতিষ্ঠা
আয়ুব খান চাইছিলেন তাঁর শাসনের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা গণআন্দোলনকে দুর্বল করতে। তাই জনগণের চোখে মুজিবকে রাষ্ট্রবিরোধী হিসেবে উপস্থাপন করে নিজেদের দমননীতি বৈধতা দিতে চেয়েছিলেন।
৬. আন্তর্জাতিক চাপ মোকাবিলা
সে সময় বিশ্বের অনেক দেশ পাকিস্তানে গণতন্ত্রের দাবি জানাচ্ছিল। মুজিবুর রহমানের মতো জনপ্রিয় নেতাকে “ষড়যন্ত্রকারী” প্রমাণ করা হলে আন্তর্জাতিক মহলে তাকে ছোট করে দেখানো যেত।
মামলার ফলাফল
১. মামলা প্রত্যাহার
১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি ব্যাপক জনআন্দোলনের মুখে পাকিস্তান সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়।
২. ছাত্র আন্দোলনের বিস্তার
১৯৬৯ সালে ছাত্ররা “১১ দফা” দাবি তোলে, যা পুরো জাতিকে আন্দোলনে যুক্ত করে। আগরতলা মামলা আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে।
২. শেখ মুজিবের মুক্তি
মামলা প্রত্যাহারের পর শেখ মুজিব ও অন্যান্য আসামিরা মুক্তি পান। জনগণের চোখে শেখ মুজিব বাঙালি জাতির নিরঙ্কুশ নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন।
৩. আয়ুব খানের পতন
গণআন্দোলনের চাপে প্রেসিডেন্ট আয়ুব খান ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন। পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংকট তীব্র আকার ধারণ করে।
৫. গণঅভ্যুত্থান
এই আন্দোলন ও মামলার ফলেই ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান ঘটে। এতে আইয়ুব খান ক্ষমতা হারিয়ে ইয়াহিয়া খানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।
৪. বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে গতি
আগরতলা মামলা ও গণঅভ্যুত্থান বাঙালির মুক্তির সংগ্রামে নতুন গতি আনে। শেখ মুজিবুর রহমান জাতির অবিসংবাদিত নেতা হয়ে ওঠেন।
আগরতলা মামলার তাৎপর্য
-
শেখ মুজিবের নেতৃত্বের স্বীকৃতি:
মামলার পর শেখ মুজিব বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা হয়ে ওঠেন। জনগণ তাকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করে। - জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা: মামলার বিরুদ্ধে ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, বুদ্ধিজীবী ও সাধারণ মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়। এটি জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের ভিত্তি তৈরি করে।
-
গণতান্ত্রিক চেতনার বিকাশ:
পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ষড়যন্ত্রের মুখে জনগণ গণতন্ত্রের পক্ষে আরও দৃঢ় হয়। -
স্বাধীনতার ভিত্তি:
আগরতলা মামলা ও এর বিরুদ্ধে আন্দোলন স্বাধীনতা সংগ্রামের পূর্বভূমিকা হিসেবে কাজ করে। এর মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর একটি রাজনৈতিক ফাঁদ। তারা ভেবেছিল, এর মাধ্যমে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে চিরতরে স্তব্ধ করা যাবে। কিন্তু ফলাফল হয় উল্টো। এই মামলাই বাঙালি জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে তোলে এবং শেখ মুজিবকে জাতির অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত করে। মামলার বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলনের ফলেই ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান ঘটে, যা স্বাধীনতার সংগ্রামকে ত্বরান্বিত করে।
অতএব, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাকে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক বলা যায়। এটি বাঙালি জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণ ও স্বাধীনতার চেতনার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।