গ' বিভাগ
বাংলার ইতিহাস। অনার্স তৃতীয় বর্ষ।
অজকের আলোচনা, বাংলায় পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তনে খ্রিষ্টান মিশনারীদের ভূমিকার বিবরণ।
বাংলায় পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তন। |
প্রশ্নঃ বাংলায় পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তনে খ্রিষ্টান মিশনারীদের ভূমিকার বিবরণ দাও।
অথবা, বাংলায় পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তনে মিশনারিদের অবদান উল্লেখ কর।
অথবা, বাংলায় পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তনে খ্রিষ্টান মিশনারী কি কি ভূমিকা পালন করেছিল?
উত্তর: ভূমিকা: ১৬০০ সালের দিকে ইংরেজ বণিকেরা যখন ভারতে বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে আগমন করেন, তখন তাদের সঙ্গে খ্রিষ্টান ধর্মযাজকেরাও ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে এ দেশে আসেন। এই ধর্মযাজকদের মিশনারী বলা হয়। মিশনারীরাই বাংলায় পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রথম সূচনা করেছিলেন। খ্রিষ্টান ধর্মের প্রচার ও ভারতীয় সমাজের কুসংস্কারের অন্ধকার দূর করার লক্ষ্যে তারা শিক্ষার প্রসার ঘটিয়ে যে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন, তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই।
বাংলায় পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তনে মিশনারীদের ভূমিকা:
১.অবৈতনিক স্কুল প্রতিষ্ঠা: ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে আগত খ্রিষ্টান মিশনারীরা বাঙালিদের শিক্ষার মাধ্যমে আলোকিত করতে বিশেষ উদ্যোগ নেন। এর অংশ হিসেবে ১৭৩১ সালে সেন্ট অ্যান্ড্রুজ প্রেসবিটেরিয়ান চার্চের উদ্যোগে তারা প্রথম একটি অবৈতনিক স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। এই স্কুলে ইংরেজি ভাষাসহ জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ের শিক্ষা প্রদান করা হতো।
২.কলকাতায় ইংরেজি স্কুল প্রতিষ্ঠা: বাংলায় শিক্ষার বিস্তার ঘটানোর উদ্দেশ্যে খ্রিষ্টান মিশনারীরা কলকাতাসহ আশপাশের বিভিন্ন স্থানে ইংরেজি স্কুল স্থাপন করেন। মধ্য কলকাতায় হেনরি ড্রামন্ড "ধর্মতলা একাডেমী" নামে একটি ইংরেজি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়াও ভবানীপুরে জগমোহন বসু এবং চুঁচুড়ায় ফোর্বেশ সাহেব একটি ইংরেজি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ইংরেজি ভাষার পাশাপাশি নানা বিষয়ে আধুনিক জ্ঞানচর্চার সুযোগ সৃষ্টি করে।
৩.উইলিয়াম কেরীর অবদান: বাংলায় শিক্ষা বিস্তারে যেসব বিদ্বান ও মানবতাবাদী ব্যক্তি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন, তাদের মধ্যে উইলিয়াম কেরী সর্বাগ্রে এবং সর্বোচ্চভাবে স্মরণীয়। তিনি ১৭৯৩ সালে খ্রিষ্টান মিশনারী হিসেবে ভারতবর্ষে আগমন করেন। বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করার লক্ষ্যে তিনি অসামান্য কাজ করেন, যার মধ্যে বাংলা ব্যাকরণ রচনা, ছাপাখানা স্থাপন এবং পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন বিশেষ উল্লেখযোগ্য। তার এই উদ্যোগ বাংলায় শিক্ষার প্রসারে গভীর প্রভাব ফেলেছিল।
৪.শ্রীরামপুর মিশন প্রতিষ্ঠা: প্রাথমিকভাবে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাদের এলাকার মধ্যে মিশনারীদের কার্যক্রম পরিচালনার অনুমতি দেয়নি। তাই উইলিয়াম কেরীর নেতৃত্বে মিশনারীরা ডেনিশ কোম্পানির অধীনস্থ শ্রীরামপুরে একটি মিশন প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে জযুয়া মার্শম্যান এবং উইলিয়াম ওয়ার্ডকে সঙ্গে নিয়ে কেরী বিদ্যালয় এবং ছাপাখানা স্থাপন করেন। শ্রীরামপুর মিশনের অধীনে আরও অনেক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়, যা বাংলায় শিক্ষার প্রসারে বিশেষ ভূমিকা রাখে।
৫.হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠা: ১৮১৮ সালে শ্রীরামপুর মিশনের উদ্যোগে হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়, যা বাংলায় শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হয়। এই কলেজ বাংলা তথা সমগ্র ভারতবাসীর জন্য একটি জ্ঞানের আলোকবর্তিকা হয়ে ওঠে। হিন্দু কলেজের শিক্ষায় পাশ্চাত্য ধারায় শিক্ষিত হয়ে অনেক বাঙালি মনীষী সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে গৌরবোজ্জ্বল স্থান অর্জন করেন। বাংলায় মুক্ত ও উদারনৈতিক শিক্ষা প্রসারে এই কলেজের অবদান অসীম ও চিরস্মরণীয়।
৬.বুক সোসাইটি প্রতিষ্ঠা: শিক্ষার উন্নয়ন ও পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের লক্ষ্যে শ্রীরামপুর মিশনের উদ্যোগে ১৮১৮ সালে কলকাতা স্কুল বুক সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই সংস্থা থেকে মিশনারীরা ইতিহাস, ভূগোল, ভাষাবিজ্ঞান, দর্শন, যুক্তিবিদ্যা এবং সাধারণ বিজ্ঞানসহ বিভিন্ন বিষয়ে গ্রন্থ প্রণয়ন করে তা শিক্ষার্থীদের মাঝে বিতরণ করতেন। তাদের এই উদ্যোগ শিক্ষার আধুনিকীকরণ ও জ্ঞানের বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
৭.নানা স্থানে বিদ্যালয় স্থাপন: মিশনারীগণ তাদের ধর্মীয় আদর্শ এবং শিক্ষার প্রসারের লক্ষ্যে কলকাতা ও আশপাশের বিভিন্ন জনপদে অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। ১৮১৭ সালের মধ্যেই এসব বিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা সাত হাজার অতিক্রম করে। এই বিদ্যালয়গুলোতে শ্রীরামপুর মিশনের প্রবর্তিত পাঠ্যক্রম অনুযায়ী সাহিত্য, গণিত, ভূগোল, ইতিহাস এবং বিজ্ঞানসহ বিভিন্ন বিষয় পড়ানো হতো। তাদের এই প্রচেষ্টা বাংলা অঞ্চলে শিক্ষার প্রসারে গভীর প্রভাব ফেলে।
৮.স্কটিশ মিশনারীদের স্কুল: বাংলায় পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারে স্কটিশ মিশন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। স্কটিশ লর্ড বিকাশ কলকাতায় একটি স্কুল এবং একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে পাশ্চাত্য শিক্ষা চালু হয়, যা বাংলার সমাজে আধুনিক শিক্ষার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। স্কটিশ মিশনারীদের প্রচেষ্টায় শিক্ষার আধুনিক ধারার সঙ্গে বাঙালির পরিচয় ঘটে।
৯.কোম্পানির পৃষ্ঠপোষকতা লাভ: মিশনারীদের প্রচেষ্টায় যখন বাংলার জনসাধারণ পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট হতে শুরু করলো, তখন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিও শিক্ষার প্রসারে উদ্যোগী হয়। ১৮১৩ সালের চার্টার অ্যাক্ট নবীকরণের সময় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে বাংলায় শিক্ষার উন্নয়নের জন্য কোম্পানি বছরে এক লক্ষ টাকা ব্যয় করবে। মিশনারীদের কার্যক্রম এই উদ্যোগের ভিত্তি প্রস্তুত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
১০.নিজেদের স্বার্থে শিক্ষা: মিশনারীরা বাংলার জনগণকে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত করতে চেয়েছিলেন মূলত তাদের নিজস্ব স্বার্থে। চার্চের প্রধানরা সিদ্ধান্ত নেন যে ভারতে ব্রিটিশ শাসন স্থায়ী করার এবং খ্রিষ্টান ধর্মের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করার লক্ষ্যে ভারতীয়দের পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত করা প্রয়োজন। যদিও তাদের পিছনে একাধিক স্বার্থ জড়িত ছিল, তবুও এই প্রচেষ্টা বাংলার শিক্ষার উন্নতি ও সমাজে আধুনিক চিন্তাভাবনার প্রসারে সহায়ক হয়েছিল।
১১.পাঠশালার ব্যয় নির্বাহ: মিশনারীরা যেসব পাঠশালা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সেগুলোর জন্য ওয়ারেন হেস্টিংস সরকারি সহায়তা হিসেবে মাসিক ৬০০ টাকা প্রদান শুরু করেন। ১৮২১ সালে সরকার কলকাতা বুক সোসাইটিকে এককালীন ৭০০০ টাকা অনুদান দেয় এবং প্রতি মাসে ৫০০ টাকা সাহায্য দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এর মাধ্যমে সরকার মিশনারী স্কুলগুলোর ব্যয়ভার গ্রহণ করে, যা বাংলায় পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তার ও উন্নতির প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
১২.মিশনারী পাঠশালার বিস্তার: সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা পেতে শুরু করলে পাশ্চাত্য শিক্ষা সমৃদ্ধ মিশনারী পাঠশালার সংখ্যা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। দুই বছরের মধ্যে কলকাতা ও এর আশপাশের অঞ্চলে ২২টি মিশনারি স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। এছাড়াও বিভিন্ন জেলার উপর অনুসন্ধান করে দেখা যায় যে চব্বিশ পরগণায় ৩৬টি, যশোরে ৪টি, এবং নদীয়া, বাকেরগঞ্জ, চট্টগ্রাম, ত্রিপুরা, দিনাজপুর, মুর্শিদাবাদ ও রাজশাহীতে একেকটি মিশনারি স্কুল স্থাপিত হয়েছিল।
উপসংহার: উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমরা দেখতে পাই যে বাংলার শিক্ষা বিস্তারে খ্রিষ্টান মিশনারীরা অগ্রগামী ভূমিকা পালন করেছেন। যদিও তাদের উদ্দেশ্য ছিল নিজেদের স্বার্থে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ঘটানো, তবুও এই শিক্ষা বাংলার জন্য এক প্রকার শাপে বর প্রমাণিত হয়। পাশ্চাত্য শিক্ষা জনগণের মধ্যে সচেতনতা ও জাগরণ সৃষ্টি করেছে, যার ফলে ইংরেজদের বিদ্যালয়ে শিক্ষাগ্রহণকারী বাঙালি সমাজ একসময় তাদের শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। এই শিক্ষা বিকাশ নব্য বাঙালি শিক্ষিত সমাজকে শক্তিশালী করে এবং তাদের জাতীয় চেতনা ও স্বাধীনতার সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে সহায়ক হয়।