বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতির বৈশিষ্ট্য।

স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস। 

আজকের আলোচনা, বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতির বৈশিষ্ট্য।

বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতির বৈশিষ্ট্য।
বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতির বৈশিষ্ট্য।


বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতির বৈশিষ্ট্য

বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি ক্ষুদ্র আয়তনের দেশ হলেও এর ভূপ্রকৃতি অত্যন্ত বৈচিত্র্যময় ও সমৃদ্ধ। নদীনির্ভর এ দেশের ভূপ্রকৃতিতে পাহাড়, টিলা, সমভূমি, বদ্বীপ অঞ্চল ও প্লাবনভূমির অনন্য সমন্বয় লক্ষ্য করা যায়। ভূপ্রকৃতি একটি দেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ, কৃষি ব্যবস্থা, জলবায়ু ও জনগণের জীবনধারার উপর প্রত্যক্ষ প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতি মূলত তিনটি প্রধান অংশে বিভক্ত: টারশিয়ারি যুগের পাহাড়সমূহ, প্লাইস্টোসিনকালের পাহাড় বা সোপানসমূহ, এবং সাম্প্রতিককালের প্লাবন সমভূমি। এছাড়া দেশের দক্ষিণ অংশে উপকূলীয় বদ্বীপ অঞ্চল রয়েছে, যা ক্রমাগত পরিবর্তিত হচ্ছে।



দেশের ভৌগলিক অবস্থান

বাংলাদেশ উত্তর অক্ষাংশের ২০°৩৪´ থেকে ২৬°৩৮´ পর্যন্ত এবং পূর্ব দ্রাঘিমাংশের ৮৮°০১´ থেকে ৯২°৪১´ পর্যন্ত বিস্তৃত। পূর্বে মায়ানমার ও ভারতের ত্রিপুরা, মেঘালয় ও আসাম, পশ্চিমে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, উত্তরে ভারতের আসাম ও মেঘালয় এবং দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর দ্বারা বেষ্টিত।



বাংলাদেশের আয়তন ও সীমারেখা

বাংলাদেশের আয়তন প্রায় ১,৪৭,৫৭০ বর্গ কিলোমিটার। উত্তরে ভারত, পূর্বে ভারত ও মিয়ানমার, পশ্চিমে ভারত এবং দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর এর সীমারেখা গঠন করেছে। সীমান্ত রেখার দৈর্ঘ্য প্রায় ৪,২৪৭ কিলোমিটার, যার মধ্যে বৃহৎ অংশ ভারতের সাথে এবং অল্প অংশ মিয়ানমারের সাথে।



বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতির বৈশিষ্ট্য

বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতিকে সাধারণত তিনটি ভাগে বিভক্ত করা যায়—
১. টারশিয়ারি যুগের পারসমূহ
২. প্লাইস্টোসিন কালের পাহাড় বা সোপানসমূহ
৩. সাম্প্রতিক কালের প্লাবন সমভূমি
এ ছাড়া উপকূলীয় বদ্বীপ অঞ্চল বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতিতে বিশেষ বৈশিষ্ট্য যোগ করেছে।

১। টারশিয়ারি যুগের পাহাড়সমূহ

বাংলাদেশের উত্তর ও পূর্বাঞ্চল মূলত টারশিয়ারি যুগে গঠিত পাহাড়ি অঞ্চল দ্বারা পরিবেষ্টিত।

ক) উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পাহাড়সমূহ

এ অঞ্চলে সিলেট, মৌলভীবাজার ও পার্বত্য চট্টগ্রামের অংশ রয়েছে। সিলেটের পাহাড়সমূহকে টিলা বা ছোট পাহাড় বলা হয়। এগুলো সাধারণত ৩০ থেকে ৬০ মিটার উচ্চ।

খ) দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের পাহাড়সমূহ

চট্টগ্রাম, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি জেলা এ অঞ্চলে অবস্থিত। এখানে দেশের সর্বোচ্চ পাহাড় তাহসিল গড়ে ওঠা চিম্বুক পাহাড় ও কেওক্রাডং (প্রায় ১২৩০ মিটার)। এই পাহাড়সমূহ অরণ্যনির্ভর এবং প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ।



২। প্লাইস্টোসিনকালের পাহাড় বা সোপানসমূহ

ক) বরেন্দ্রভূমি

বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে রাজশাহী, নওগাঁ ও দিনাজপুর অঞ্চলে অবস্থিত। এর মাটি লালচে এবং কড়কড়ে প্রকৃতির। বরেন্দ্রভূমি কৃষির জন্য বিশেষভাবে পরিচিত।

খ) মধুপুর ও ভাওয়ালের গড়

ঢাকা, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল অঞ্চলে অবস্থিত এই সোপানভূমি প্রাচীন অ্যালুভিয়াল মাটি দিয়ে গঠিত। এখানে প্রচুর বনাঞ্চল ছিল যা বর্তমানে হ্রাস পেয়েছে।

গ) লালমাই পাহাড়

কুমিল্লা জেলায় অবস্থিত এ পাহাড়ের উচ্চতা ৪৭ মিটার। ছোট হলেও এর ভূতাত্ত্বিক গুরুত্ব রয়েছে।


৩। সাম্প্রতিককালের প্লাবন সমভূমি

বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতির মধ্যে সর্বাধিক বিস্তৃত অংশ হলো প্লাবন সমভূমি। এ সমভূমি প্রতি বছর নদীর বন্যার পানিতে নতুন পলি দ্বারা উর্বর হয়।

ক) কুমিল্লা সমভূমি

কুমিল্লা জেলার বিভিন্ন অংশজুড়ে বিস্তৃত। কৃষি উৎপাদনের জন্য এ অঞ্চল সমৃদ্ধ।

খ) সিলেট সমভূমি

সিলেট সমভূমি হাওড় অঞ্চলের জন্য বিখ্যাত। এখানে শীতকালে শুকিয়ে ফসল ফলানো হয় এবং বর্ষায় এটি বিশাল জলরাশিতে পরিণত হয়। হাওড় অঞ্চলকে বাংলাদেশের "প্রাকৃতিক জলাধার" বলা হয়।

গ) পাদদেশীয় প্লাবনভূমি

হিমালয়ের পাদদেশ থেকে নেমে আসা নদীর পলিতে গঠিত। এখানে উর্বর জমি ও কৃষি কার্যক্রম ব্যাপক।

ঘ) গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা প্লাবন সমভূমি

বাংলাদেশের প্রধান নদীগুলির প্রবাহে গঠিত এ সমভূমি কৃষি, যোগাযোগ ও জীবনযাত্রার মূল ভিত্তি।

ঙ) বদ্বীপ অঞ্চলের সমভূমি

বাংলাদেশ বিশ্বের বৃহত্তম বদ্বীপের অংশ। গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা নদীসমূহ বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়ে এ বদ্বীপ সৃষ্টি করেছে।


৪। উপকূলীয় বদ্বীপ অঞ্চল

ক) মৃতপ্রায় বদ্বীপ

যেসব অঞ্চলে নদীর স্রোত ধীরে ধীরে হ্রাস পাচ্ছে এবং পলি জমে নতুন ভূমি তৈরি হচ্ছে।

খ) সক্রিয় বদ্বীপ

নদীর স্রোতের কারণে যেসব অঞ্চলে নতুন চর জেগে উঠছে। যেমন: ভোলা, চরফ্যাশন প্রভৃতি।

গ) অপরিপক্ক বদ্বীপ

যেসব এলাকা এখনও সম্পূর্ণ স্থিতিশীল নয়। সমুদ্রের জোয়ার-ভাটা ও ঘূর্ণিঝড়ের কারণে এসব বদ্বীপ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।



বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতি বৈচিত্র্যময় এবং পরিবর্তনশীল। পাহাড়, সমভূমি, বদ্বীপ ও উপকূলীয় অঞ্চল—সব মিলিয়ে এ দেশের ভূপ্রকৃতি একদিকে যেমন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার, অন্যদিকে কৃষি, অর্থনীতি ও মানুষের জীবনযাত্রার প্রধান নির্ভরশীলতা। বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতি শুধুমাত্র প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য নয়, বরং এটি জাতীয় সংস্কৃতি ও ইতিহাসের অংশও বটে।

9 মন্তব্যসমূহ

  1. খুব ভালো লাগলো দারুণ

    উত্তরমুছুন
নবীনতর পূর্বতন