পলাশীর যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল আলোচনা কর।

পলাশীর যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল | অনার্স ৩য় বর্ষ ইতিহাস ২০২৫

গ' বিভাগ

দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস। অনার্স তৃতীয় বর্ষ।

অজকের আলোচনা, পলাশীর যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল।

পলাশীর যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল আলোচনা কর।
পলাশীর যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল।

প্রশ্নঃ পলাশীর যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল আলোচনা কর।

অথবা, ১৭৫৭ সালে সংঘটিত পলাশীর যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল তুলে ধর।

অথবা, ১৭৫৭ সালে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার মধ্যকার যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল নিরুপণ কর।

উত্তর: ভূমিকা: ১৭৫৭ সালে সংঘটিত পলাশীর যুদ্ধভা রতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় ও কলঙ্কজনক অধ্যায়। কারণ এ যুদ্ধের মাধ্যমেই বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়। শুরু হয় ইংরেজ বেনিয়াদের আধিপত্য। হতভাগ্য নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পতনের মাধ্যমে আমরা হারাই আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব। 
নিম্নে পলাশীর যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল তুলে ধরা হলো:
পলাশীর যুদ্ধের কারণ:
১. রাজনৈতিক কারণ: নবাব আলীবর্দী খানের শাসনামলে  আলীবর্দী খান ইংরেজ ও ফরাসিদের বাণিজ্য করার অনুমতি দিলেও তিনি তাদের এদেশে দুর্গ নির্মাণ ও যুদ্ধাস্ত্র রাখতে নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু তার মৃত্যুর পর ইংরেজ ও ফরাসি বণিকগণ দুর্গ নির্মাণ আরম্ভ করে এতে নবাব সিরাজ বাধা দেন। ফরাসিরা বাধা মানলেও ইংরেজরা মানেননি। এছাড়াও সিরাজুদ্দৌলা বাংলার সিংহাসনে বসার পর প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী ইংরেজরা নতুন নবাবকে কোনো উপটৌকন পাঠাননি এবং তাঁর সঙ্গে সৌজন্যেমুলক সাক্ষ্যৎ করেনি। এ পরিস্থিতিতে নবাব তাদের উপর ক্রুদ্ধ হন।
২. নবাবের আদেশ অমান্য: নবাব সিরাজ বাইরেরব ণিকদেরকে দুর্গ নির্মাণে নিষেধ করেন। কিন্তু ইংরেজরা এ আদেশ অমান্য করে। ইংরেজরা আদেশ অমান্য করলে নবাব ৫০ হাজার সৈন্য নিয়ে কলকাতা আক্রমণ করেন।
৩.অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্র: নবাব আলীবর্দী খানের কোনো পুত্র সন্তান না থাকায় আলীবর্দী খান সিরাজকে তার মৃত্যুর পর নবাব হবার কথা ঘোষণা করেন। কিন্তু সিরাজকে অনেকেই নবাব হিসেবে মেনেনিতে পারেনি। তাই তারা পরবর্তী নবাব নিয়োগের জন্য গোপনে ষড়যন্ত্র করতে থাকে। তাদের ইচ্ছা ছিল মীর জাফর সিংহাসনে বসবে। তাদের এ মনোবাসনা পরবর্তীতে ষড়যন্ত্রে রূপ লাভ করে।
৪. নবাবের শত্রুকে আশ্রয় দান: ইংরেজরা নবাব সিরাজের বিদ্রোহী কর্মচারী কৃষ্ণ দাসকে প্রচুর ধনরত্নের বিনিময়ে আশ্রয় দিলে নবাব তাকে ফেরত চায়। কিন্তু তারা ফেরত দিতে অস্বীকৃতি জানায় ফলে নবাব ক্রুদ্ধ হয় এবং এটি পলাশীর যুদ্ধের অন্যতম একটি কারণ ।
৫. কলকাতা পুনঃদখল: নবাব সিংহাসনে আরোহণ করেই কলকাতা তার দখলে আনে। কিন্তু ১৭৫৭ সালের জানুয়ারি মাসে ক্লাইভ আবার খুব সহজেই কলকাতা দখল করে। নবাব তাদের দমন করার জন্য সৈন্য পাঠান। এতে নবাব ও ইংরেজদের মধ্য এক উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। কিন্তু নবাব দেখতে পেলেন চারদিকে শুধু ষড়যন্ত্র তাই তিনি সন্ধির প্রস্তাব পাঠান। যা “আলীনগর” সন্ধি নামে পরিচিত।
৬. অর্থনৈতিক কারণ: ইংরেজরা অর্থনৈতিক দিক দিয়ে যে সমস্ত বাণিজ্যিক সুযোগ-সুবিধা পেয়েছিল তারা এ সুযোগ-সুবিধার অপব্যবহার করতে থাকে। ফলে নবাব তাদের প্রতি বিদ্বেষী ভাব পোষণ করতে থাকে।
৭. নবাবের অদূরদর্শিতা: নবাব সিরাজ সিংহাসনে আরোহণ করে বিচক্ষণতা ও দক্ষতা প্রদর্শন না করে উদারতা প্রদর্শন করেন। তার এ উদারতার সুযোগ নিয়ে অপরপক্ষ ষড়যন্ত্র করতে থাকে। কিন্তু সরল বিশ্বাসী নবাব ষড়যন্ত্রকারীদেরকে কঠোরহস্তে দমন করতে পারেননি। কোনো বলিষ্ঠ পদক্ষেপ ও গ্রহণ করেননি। যার ফলে যুদ্ধের ক্ষেত্র রচিত হয়।
পলাশীর যুদ্ধের ফলাফল:
(ক) রাজনৈতিক ফলাফল:
১. পলাশীর যুদ্ধের ফলে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার
স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হয়।
২. পলাশীর যুদ্ধের ফলে ইংরেজরা কোম্পানির মর্যাদা বৃদ্ধি পাই।
৩. পলাশীর যুদ্ধের পর ইংরেজরা এদেশের ত্রাণকর্তা হিসেবে পরিণত হয়।
৪. বিশ্বাসঘাতকতার প্রতিদান স্বরূপ মীর জাফর নামে মাত্র নবাবী লাভ করে। প্রকৃত ক্ষমতা ক্লাইভের হাতেই থেকে যায়।
(খ) অর্থনৈতিক ফলাফল:
১। মীর জাফরের সাথে চুক্তি মোতাবেক পলাশীর যুদ্ধের পর ইংরেজরা প্রচুর অর্থ-সম্পত্তির মালিক হয়। তাদের ব্যবসায়-বাণিজ্য তখন সরগরমভাবে চলতে থাকে।
২। যেহেতু মুসলমানরা ছিল ইংরেজদের বিরুদ্ধ পক্ষ। তাই পলাশীর যুদ্ধের পর তারা ইংরেজদের রোষালনে পড়ে। এতে করে তাদের অর্থনৈতিক ভিত্তি নাজুক হয়ে পড়ে।
৩। এ যুদ্ধের পর ইংরেজ কোম্পানি একচেটিয়া বাণিজ্যিক অধিকার পায়। এতে দেশীয় বণিকদের ব্যাপক ক্ষতি হয়।
(গ) সম্প্রদায়গত ফলাফল :
১। ভারতীয় মুসলমানগণ এতদিন প্রচণ্ড প্রতাপে নিজেদের মর্যাদাকে সমুন্নত রেখেছে। কিন্তু পলাশী যুদ্ধের পর তাদের আধিপত্য ও প্রাধান্য শূন্যের কোঠায় গিরে দাঁড়ায়।
২। ইংরেজরা ক্ষমতার বসায় হিন্দুরা তাদের সমর্থন দানের প্রতিদান স্বরূপ নানা রকম সুযোগ-সুবিধা পেয়ে নিজেদের ভাগ্যের উন্নতি সাধন করে।
(ঘ) ইঙ্গ-ফরাসি সংঘাতের উপর প্রভাব : পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজদের জয়লাভের পর দাক্ষিণাত্য ইঙ্গ-ফরাসি সংঘাতের গতিপথে বিপুল প্রভাব বিস্তার করে। এর ফলে বঙ্গদেশের সম্পদ, জনবল ও অর্থবল সবই ইংরেজদের হাতে চলে যায়। কর্নাটের যুদ্ধে এ সকল সম্পদ ফরাসিদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হয়। এভাবে কর্নাটের তৃতীয় যুদ্ধে বঙ্গের সম্পদের বলে ইংরেজরা দাক্ষিণাত্যে ফরাসিদের পরাজিত করে।
(ঙ) ভারতীয় উপমহাদেশে বিজয়ের পথ প্রশস্ত: পলাশীর যুদ্ধ বঙ্গ দেশে এবং পরে সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশে ইংরেজরা বিজয়ের পথ প্রশস্ত করে।
(চ) শিক্ষার পরিবর্তন: পলাশীর যুদ্ধের পর দেশে মুঘল ও ভারতীয় শিক্ষা সভ্যতার স্থানে ইউরোপীয় সভ্যতা আত্ম প্রকাশ করতে থাকে। কালক্রমে বাংলা তথা ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম শিক্ষা সংস্কৃতি বিপদাপন্ন হতে থাকে।
উপসংহার: সামরিক দিক দিয়ে পলাশীর যুদ্ধ খুব গুরুত্বপূর্ণ না হলেও রাজনৈতিক দিক দিয়ে এটি ছিল নিঃসন্দেহে বাংলার ইতিহাসে একটি সর্বাধিক বেদনাবহ ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এ যুদ্ধে জয়লাভের ফলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাণিজ্যিক শক্তি থেকে রাজনৈতিক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে পড়ে

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন