স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ১৯৭০ সালের নির্বাচনের প্রভাব।

স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস

আজকের আলোচনা, স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ১৯৭০ সালের নির্বাচন প্রভাব ও তাৎপর্য

স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ১৯৭০ সালের নির্বাচনের প্রভাব।



স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ১৯৭০ সালের নির্বাচন: প্রভাব ও তাৎপর্য


বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন একটি অনন্য মাইলফলক। এটি ছিল পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচন, যেখানে দেশের জনগণ প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে তাদের মতামত প্রকাশের সুযোগ পেয়েছিল। এই নির্বাচন শুধু একটি রাজনৈতিক ঘটনার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং এটি স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ভিত্তি স্থাপন করেছিল। নির্বাচনের ফলাফল, পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর প্রতিক্রিয়া এবং পরবর্তী ঘটনাবলি মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার পথ প্রশস্ত করে। নিচে এই নির্বাচনের প্রেক্ষাপট, ফলাফল ও প্রভাব বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।


প্রেক্ষাপট

১. পাকিস্তান সৃষ্টির পর বৈষম্য

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল মুসলমানদের জন্য আলাদা মাতৃভূমি হিসেবে। কিন্তু রাষ্ট্র গঠনের পর থেকেই পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

  • অর্থনৈতিকভাবে পশ্চিম পাকিস্তান উন্নয়নের সুবিধা ভোগ করছিল, অথচ পূর্ব পাকিস্তান উপেক্ষিত হচ্ছিল।
  • রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও পূর্ব পাকিস্তান বারবার বঞ্চিত হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী হয়েও তারা ক্ষমতার অংশীদার হতে পারেনি।

২. ভাষা আন্দোলনের উত্তরাধিকার

১৯৪৮ সালে রাষ্ট্রভাষা নিয়ে বিরোধ শুরু হয় এবং ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে শহীদদের রক্তে বাঙালি জাতীয়তাবাদ সুদৃঢ় হয়। ভাষার প্রশ্ন থেকে শুরু করে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের আন্দোলন জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে।

৩. ছয় দফা কর্মসূচি

১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা কর্মসূচি উপস্থাপন করেন, যা পূর্ব বাংলার মুক্তির সনদ হিসেবে বিবেচিত হয়। এতে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি উত্থাপিত হয়। এই কর্মসূচি জনগণের মধ্যে ব্যাপক সমর্থন পায় এবং জাতীয়তাবাদী চেতনা আরও জোরালো হয়।

৪. প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও সরকারি ব্যর্থতা

১৯৭০ সালের নভেম্বরে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে উপকূলীয় অঞ্চলে প্রায় ৫ লাখ মানুষ মারা যায়। কেন্দ্রীয় সরকারের অবহেলা ও ত্রাণ কার্যক্রমে গাফিলতির কারণে জনগণের ক্ষোভ আরও তীব্র হয়। এতে বাঙালিরা পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর প্রতি আস্থা হারায়।


১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন

পাকিস্তানের ইতিহাসে এই নির্বাচন ছিল প্রথম সাধারণ নির্বাচন, যেখানে সরাসরি জনগণ ভোট দেওয়ার সুযোগ পায়।

  • জাতীয় পরিষদের মোট আসন: ৩০০
  • পূর্ব পাকিস্তানে আসন সংখ্যা: ১৬২
  • পশ্চিম পাকিস্তানে আসন সংখ্যা: ১৩৮

নির্বাচনে প্রধান দলগুলো

  1. আওয়ামী লীগ (শেখ মুজিবুর রহমান): পূর্ব পাকিস্তান ভিত্তিক দল, ছয় দফা কর্মসূচিকে মূল ইশতেহার করে।
  2. পাকিস্তান পিপলস পার্টি (জুলফিকার আলী ভুট্টো): পশ্চিম পাকিস্তান ভিত্তিক দল, “ইসলামি সমাজতন্ত্র” ও পশ্চিম পাকিস্তানের স্বার্থ রক্ষায় সোচ্চার।

নির্বাচনের ফলাফল

  • আওয়ামী লীগ ১৬২টির মধ্যে ১৬০ আসন লাভ করে এবং জাতীয় পরিষদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে।
  • পাকিস্তান পিপলস পার্টি ১৩৮টির মধ্যে ৮১ আসন পায়, তবে তারা পূর্ব পাকিস্তানে একটি আসনও জিততে পারেনি।

ফলাফল ছিল স্পষ্ট: পাকিস্তানের জনগণ শেখ মুজিবুর রহমানকে দেশের ভবিষ্যৎ নেতা হিসেবে বেছে নিয়েছিল।


নির্বাচনের প্রভাব

১. বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিজয়

আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় প্রমাণ করে যে বাঙালি জনগণ ছয় দফা কর্মসূচিকে তাদের মুক্তির সনদ হিসেবে গ্রহণ করেছে। এটি বাঙালি জাতীয়তাবাদের একটি সাংবিধানিক স্বীকৃতি ছিল।

২. ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি

সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান ও ভুট্টো শেখ মুজিবকে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে অস্বীকৃতি জানায়। ভুট্টো ঘোষণা দেন, “উভয় প্রদেশের সম্মতি ছাড়া কোনো সরকার গঠন করা যাবে না।” এতে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া স্থবির হয়ে যায়।

৩. রাজনৈতিক সংকট তীব্রতর হওয়া

আওয়ামী লীগের বিজয়ের পরও জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান বিলম্বিত করা হয়। এতে বাঙালি জনগণের মধ্যে ক্ষোভ বৃদ্ধি পায়। মার্চ ১৯৭১-এ আন্দোলন ব্যাপক আকার ধারণ করে।

৪. অসহযোগ আন্দোলন

১৯৭১ সালের মার্চ মাসে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে সারা দেশে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। effectively পাকিস্তানের প্রশাসন, বিচারব্যবস্থা, এমনকি কর আদায়ও ঢাকা থেকে পরিচালিত হতে থাকে। পূর্ব পাকিস্তান কার্যত স্বাধীন রাষ্ট্রের মতো চলতে থাকে।

৫. ২৫ মার্চের গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধ

ক্ষমতা হস্তান্তরে ব্যর্থ হয়ে পাকিস্তানি সেনারা ২৫ মার্চ রাতে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ চালায়। ঢাকা ও অন্যান্য শহরে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ ঘটে। এর মাধ্যমে পাকিস্তানি সেনারা বাঙালির গণতান্ত্রিক রায়কে অগ্রাহ্য করে দমননীতি প্রয়োগ করে। ফলস্বরূপ মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হয় এবং ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে।


নির্বাচনের তাৎপর্য

  1. গণতান্ত্রিক ম্যান্ডেটের প্রমাণ: বাঙালি জনগণ প্রথমবারের মতো তাদের স্বাধীনতার পক্ষে রায় দিয়েছিল।
  2. পাকিস্তানি রাষ্ট্র কাঠামোর ভাঙন: নির্বাচন প্রমাণ করে পাকিস্তান একটি রাষ্ট্র হিসেবে টিকতে পারবে না, কারণ দুই অংশের মানুষের আকাঙ্ক্ষা ভিন্ন।
  3. স্বাধীনতার পথ প্রশস্ত: এই নির্বাচনের ফলাফলই স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক বৈধতা তৈরি করেছিল।
  4. আন্তর্জাতিক মনোযোগ: বিশ্বের অন্যান্য দেশও নির্বাচনের ফলাফলের প্রতি দৃষ্টি রাখে। পরবর্তীতে স্বাধীনতার পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন অর্জনে এটি সহায়ক হয়।


১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন ছিল শুধু একটি নির্বাচন নয়, বরং এটি ছিল বাঙালি জাতির ভাগ্যনির্ধারণী রায়। এই নির্বাচনের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছিল যে পূর্ব বাংলার জনগণ স্বায়ত্তশাসন চায় এবং পাকিস্তানি শাসন আর মেনে নিতে রাজি নয়। তবে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী এই গণরায় অস্বীকার করে সামরিক শক্তির আশ্রয় নেয়। এর ফলেই মুক্তিযুদ্ধের জন্ম হয় এবং ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।

অতএব, ১৯৭০ সালের নির্বাচনকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার “গণভিত্তিক ঘোষণা” বলা যায়। এটি বাঙালি জাতির গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা, সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের চূড়ান্ত বিজয়ের ভিত্তি তৈরি করেছিল।

1 মন্তব্যসমূহ

নবীনতর পূর্বতন