স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস।
আজকের আলোচনা, ১৯৪৭ সালের ভারত বিভাজনের কারণ ও প্রেক্ষাপট।
![]() |
| ১৯৪৭ সালের ভারত বিভাজনের কারণ ও প্রেক্ষাপট। |
আরও পড়ুনঃ
১৯৪৭ সালের ভারত বিভাজনের কারণ ও প্রেক্ষাপট।
১৯৪৭ সাল দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় মাইলফলক। এই বছরেই ভারত স্বাধীনতা লাভ করে এবং পাশাপাশি ঘটেছিল উপমহাদেশের বিভাজন, যার ফলে সৃষ্টি হয় দুটি নতুন রাষ্ট্র—ভারত ও পাকিস্তান। ভারত বিভাজন ছিল একদিকে স্বাধীনতার আনন্দ, অন্যদিকে দুঃখ, বেদনা ও রক্তক্ষয়ী সংঘাতের ইতিহাস। বিভাজনের পেছনে দীর্ঘ রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, অর্থনৈতিক বৈষম্য, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ভিন্নতা এবং আন্তর্জাতিক কূটনীতির ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। নিচে ১৯৪৭ সালের ভারত বিভাজনের কারণ ও প্রেক্ষাপট বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনের প্রেক্ষাপট
১৭৫৭ সালের প্লাসির যুদ্ধের পর ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের সূচনা হয়। ধীরে ধীরে ইংরেজরা ভারতকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিকভাবে তাদের অধীনে নিয়ে আসে। প্রায় দুই শতাব্দীর শাসনামলে ইংরেজরা ভারতীয় সমাজকে নিজেদের স্বার্থে বিভক্ত ও দুর্বল করে রাখে। হিন্দু-মুসলমান বিভাজনের বীজ তারা বপন করেছিল সচেতনভাবেই, যাতে কোনো একক জাতীয় ঐক্য গড়ে উঠতে না পারে।
সাম্প্রদায়িক বিভাজনের শিকড়
ব্রিটিশ শাসনামলে হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে ক্রমাগত দূরত্ব তৈরি হয়। এর প্রধান কারণসমূহ হলো—
- অর্থনৈতিক বৈষম্য: ব্রিটিশ শাসকরা চাকরির ক্ষেত্রে হিন্দুদের প্রাধান্য দিত। ফলে মুসলমানরা প্রশাসন ও শিক্ষাক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ে।
- সাংস্কৃতিক পার্থক্য: হিন্দু ও মুসলমানদের সামাজিক রীতি, ধর্মীয় আচার, ভাষা ও সংস্কৃতির মধ্যে পার্থক্য ক্রমেই সংঘাত সৃষ্টি করে।
- শিক্ষানীতি: ১৯শ শতাব্দীর ইংরেজি শিক্ষানীতির ফলে হিন্দুরা বেশি উপকৃত হলেও মুসলমানরা নিজেদের ঐতিহ্যবাহী মাদ্রাসা শিক্ষায় সীমাবদ্ধ থাকে। এতে করে মুসলমানদের মধ্যে ক্ষোভ জমা হয়।
মুসলিম লীগের উত্থান
১৯০৬ সালে ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহর উদ্যোগে অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। মুসলিম লীগ মুসলমানদের রাজনৈতিক অধিকার ও স্বতন্ত্র জাতিসত্তার দাবি উত্থাপন করে। অন্যদিকে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ভারতীয়দের স্বাধীনতার দাবি তোলে, কিন্তু মুসলমানদের অনেক দাবি ও উদ্বেগকে উপেক্ষা করে। ফলে দুই দলের মধ্যে সমঝোতা সম্ভব হয়নি।
বঙ্গভঙ্গ ও তার প্রভাব
১৯০৫ সালে লর্ড কার্জন বঙ্গভঙ্গ ঘোষণা করেন। এতে পূর্ব বাংলা ও আসাম নিয়ে আলাদা একটি প্রদেশ গঠিত হয়। মুসলমানরা এটিকে স্বাগত জানালেও হিন্দুরা প্রবলভাবে বিরোধিতা করে। ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হলে মুসলমানদের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি হয়। তারা বুঝতে পারে, হিন্দুদের আধিপত্যের কারণে মুসলিম স্বার্থ বারবার উপেক্ষিত হচ্ছে। এটি মুসলমানদের আলাদা রাজনৈতিক চিন্তার ভিত্তি শক্তিশালী করে।
হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের অবনতি
১ম বিশ্বযুদ্ধের পর হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের কিছু প্রচেষ্টা দেখা দিলেও খুব দ্রুতই সম্পর্ক খারাপ হতে শুরু করে। খিলাফত আন্দোলনের ব্যর্থতা, কংগ্রেসের একতরফা কার্যকলাপ এবং প্রাদেশিক রাজনীতিতে হিন্দু আধিপত্য মুসলমানদের ক্ষুব্ধ করে তোলে।
১৯৩৭ সালের নির্বাচনে কংগ্রেস বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে এবং উত্তরপ্রদেশে সরকার গঠন করে। সেখানে মুসলমানদের অনেক দাবি উপেক্ষা করা হয়। মুসলিম লীগ ক্রমে মুসলিমদের প্রধান রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
লাহোর প্রস্তাব ১৯৪০
১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ লাহোরে সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের অধিবেশনে "লাহোর প্রস্তাব" গৃহীত হয়। এই প্রস্তাবে বলা হয়, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলো নিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করতে হবে। পরবর্তীতে এটি “পাকিস্তান প্রস্তাব” নামে পরিচিত হয়। এই প্রস্তাব ভারত বিভাজনের পথকে সুস্পষ্ট করে দেয়।
২য় বিশ্বযুদ্ধ ও ব্রিটিশ সংকট
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশরা ভারতীয় নেতাদের সমর্থন চায়। কংগ্রেস "ভারত ছাড়ো আন্দোলন" শুরু করলেও মুসলিম লীগ ব্রিটিশদের সমর্থন করে। ফলে ব্রিটিশ শাসকরা মুসলিম লীগের গুরুত্ব আরও বাড়িয়ে দেয়। যুদ্ধোত্তর কালে ব্রিটিশরা দুর্বল হয়ে পড়ে এবং দ্রুত ভারত ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনা
১৯৪৬ সালে ব্রিটিশ সরকার ক্যাবিনেট মিশন পাঠায়। এর উদ্দেশ্য ছিল ভারতকে ঐক্যবদ্ধ রেখে স্বশাসন দেওয়া। কিন্তু কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ কোনো সমঝোতায় পৌঁছাতে পারেনি। মুসলিম লীগ স্বাধীন রাষ্ট্র ছাড়া আর কিছুতে রাজি হয়নি।
সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা
১৯৪৬ সালে কলকাতায় ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়, যা "গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং" নামে পরিচিত। কয়েক হাজার মানুষ নিহত হয়। এরপর নোয়াখালী ও বিহারে ব্যাপক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। এসব ঘটনা হিন্দু-মুসলমানের সহাবস্থানকে আরও অসম্ভব করে তোলে।
মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা ও বিভাজন
১৯৪৭ সালে লর্ড মাউন্টব্যাটেন শেষ ভাইসরয় হিসেবে ভারতে আসেন। তিনি বুঝতে পারেন, কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে সমঝোতা সম্ভব নয়। তাই ব্রিটিশ সরকার ৩ জুন ১৯৪৭ সালে বিভাজন পরিকল্পনা ঘোষণা করে। পরিকল্পনা অনুযায়ী ভারত ও পাকিস্তান দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়। পাকিস্তান গঠিত হয় পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) নিয়ে।
বিভাজনের তাৎক্ষণিক ফলাফল
- ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা: প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ নিহত হয় এবং কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়।
- শরণার্থী সংকট: হিন্দু ও মুসলমানরা নিজেদের নিরাপদ অঞ্চলে যেতে বাধ্য হয়।
- অর্থনৈতিক ক্ষতি: শিল্প ও কৃষি উৎপাদন ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
- দীর্ঘমেয়াদি দ্বন্দ্ব: ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী শত্রুতার সূত্রপাত হয়, যা আজও বিদ্যমান।
বিভাজনের ঐতিহাসিক গুরুত্ব
ভারত বিভাজন শুধু রাজনৈতিক ঘটনার সমাপ্তি নয়, এটি দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসে গভীর প্রভাব ফেলেছিল।
- মুসলমানরা আলাদা রাষ্ট্রের স্বপ্ন পূরণ করেছিল।
- ভারত তার স্বাধীনতা পেয়েছিল।
- তবে কোটি মানুষের বাস্তুচ্যুতি ও দুঃখ-কষ্ট এক অবিস্মরণীয় ট্র্যাজেডি হয়ে রয়ে গেছে।
১৯৪৭ সালের ভারত বিভাজন ছিল বহুমাত্রিক কারণের ফলাফল। সাম্প্রদায়িক বিভাজন, অর্থনৈতিক বৈষম্য, কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের দ্বন্দ্ব, ব্রিটিশ শাসকদের নীতি এবং আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট মিলেই এই বিভাজন ঘটেছিল। এটি একদিকে স্বাধীনতার আনন্দ নিয়ে এসেছিল, অন্যদিকে কোটি মানুষের কান্না, রক্ত ও অশ্রু দিয়ে রচিত হয়েছিল বিভাজনের ইতিহাস।

❤️❤️❤️❤️❤️
উত্তরমুছুন♥️♥️♥️♥️
উত্তরমুছুনWow
উত্তরমুছুন