স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ইতিহাস
আজকের আলোচনা, আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার পটভূমি।
![]() |
| আওয়ামী মুসলিম লীগ। |
আরও পড়ুনঃ
আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার পটভূমি
পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের পরপরই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে পূর্ব বাংলা তথা পূর্ব পাকিস্তানের মানুষকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী সমান মর্যাদা দিতে রাজি নয়। যদিও ১৯৪৭ সালের ভারত বিভাজনের সময় পাকিস্তান সৃষ্টির আন্দোলনে পূর্ব বাংলার মুসলমানেরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল, কিন্তু স্বাধীনতার পর দেখা গেল পশ্চিম পাকিস্তান–কেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থা কার্যত পূর্ব বাংলাকে বঞ্চিত করছে। এই অব্যাহত বৈষম্য, রাজনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়া এবং সাংস্কৃতিক অস্তিত্ব অস্বীকারের কারণে এক পর্যায়ে নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এই পরিস্থিতিতেই জন্ম নেয় "পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ", যা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্বে আসে।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট ও পূর্ব বাংলার অবস্থা
১৯৪৭ সালের আগস্টে ভারত বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়। মুসলিম লীগ তখন ছিল পাকিস্তান সৃষ্টির প্রধান রাজনৈতিক শক্তি। কিন্তু পাকিস্তান সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে যে আদর্শ ও প্রত্যাশার কথা বলা হয়েছিল—ইসলামের ভিত্তিতে ন্যায়, সমতা, এবং সাম্যের সমাজ প্রতিষ্ঠা—তা বাস্তবায়িত হলো না। বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে শোষিত হতে লাগল।
পূর্ব পাকিস্তান জনসংখ্যার দিক থেকে ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ (প্রায় ৫৬ শতাংশ)। কিন্তু রাষ্ট্রক্ষমতার সব সিদ্ধান্ত, রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং প্রশাসনিক কাঠামোতে প্রাধান্য ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের। ঢাকা ও পূর্ব বাংলার মানুষ শিগগিরই বুঝতে পারল যে তারা আসলে এক নতুন ধরণের উপনিবেশিক শাসনের শিকার হয়েছে।
ভাষা প্রশ্ন ও সাংস্কৃতিক বৈষম্য
রাষ্ট্রভাষা প্রশ্ন ছিল সবচেয়ে বড় সংঘাতের সূচনা। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব দেয়। পূর্ব বাংলার মানুষ, যারা বাংলা ভাষাকে নিজেদের পরিচয় ও সংস্কৃতির মূল হিসেবে ধরে রেখেছিল, তা মেনে নিতে পারেনি।
১৯৪৮ সালের মার্চে ঢাকায় পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা দেন যে “উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।” এই ঘোষণা পূর্ব বাংলার শিক্ষিত তরুণ, ছাত্রসমাজ এবং বুদ্ধিজীবীদের তীব্র ক্ষোভ সৃষ্টি করে। ভাষা আন্দোলনের বীজ তখনই রোপিত হয়। কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ এই আন্দোলনে জনগণের পাশে না দাঁড়িয়ে শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে অবস্থান নেয়।
অর্থনৈতিক বৈষম্য
অর্থনৈতিক দিক থেকেও পূর্ব বাংলার অবস্থা ছিল করুণ। পূর্ব পাকিস্তান ছিল কৃষিভিত্তিক অঞ্চল এবং এখান থেকে দেশটির রপ্তানি আয়ের মূল অংশ আসত—বিশেষ করে পাট রপ্তানি থেকে। কিন্তু এই আয়ের সিংহভাগই ব্যয় হতো পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্পায়ন ও সামরিক খাতে।
পূর্ব বাংলার জনগণ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অবকাঠামো, শিল্প–সব ক্ষেত্রেই পিছিয়ে পড়ে। এ বৈষম্যের কারণে কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে তীব্র অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে।
মুসলিম লীগের সীমাবদ্ধতা
পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা ছিল, পাকিস্তান রাষ্ট্রে মুসলিম লীগ তাদের স্বার্থ রক্ষা করবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, মুসলিম লীগ পূর্ব বাংলার কৃষক, শ্রমিক, মধ্যবিত্ত এবং ছাত্রসমাজের দাবি উপেক্ষা করছে। কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব পশ্চিম পাকিস্তানভিত্তিক হওয়ায় তারা বাঙালির জীবন-সংগ্রামের বাস্তবতা বুঝতে অক্ষম ছিল।
ফলে পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক কর্মীরা অনুভব করলেন যে জনগণের দাবি বাস্তবায়নের জন্য একটি নতুন রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম গঠন করা জরুরি।
আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা
এই প্রেক্ষাপটে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার রোজ গার্ডেনে এক ঐতিহাসিক সভার আয়োজন করা হয়। সেখানে বিভিন্ন তরুণ প্রগতিশীল রাজনীতিবিদ, ছাত্রনেতা এবং মুসলিম লীগের অসন্তুষ্ট কর্মীরা একত্রিত হন। তাদের লক্ষ্য ছিল এমন একটি সংগঠন গঠন করা, যা সত্যিকারের জনগণের কণ্ঠস্বর হবে এবং পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অধিকার রক্ষার সংগ্রামে নেতৃত্ব দেবে।
এই সভাতেই আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’।
- সভাপতি নির্বাচিত হন মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী।
- সাধারণ সম্পাদক হন শামসুল হক।
- গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান, যিনি পরবর্তীতে দলের প্রধান চালিকাশক্তি হয়ে ওঠেন।
দলের লক্ষ্য ও কর্মসূচি
- আওয়ামী মুসলিম লীগের মূল লক্ষ্য ছিল—
- পূর্ব বাংলার মানুষের রাজনৈতিক অধিকার নিশ্চিত করা।
- বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়া।
- কৃষক ও শ্রমিকের উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করা।
- গণতান্ত্রিক ও জনগণের অংশগ্রহণমূলক রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করা।
- পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর একচেটিয়া আধিপত্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা।
প্রাথমিক সংগ্রাম
প্রতিষ্ঠার পর আওয়ামী মুসলিম লীগ খুব দ্রুতই সাধারণ মানুষের মধ্যে জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ভাষা আন্দোলনের সময় এ দল ছাত্রসমাজের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে। পশ্চিম পাকিস্তানকেন্দ্রিক রাজনীতির বিরুদ্ধে আওয়ামী মুসলিম লীগ ক্রমশ প্রধান বিরোধী শক্তি হিসেবে গড়ে ওঠে।
১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রধান ভূমিকা পালন করে এবং মুসলিম লীগকে পরাজিত করে। এটাই প্রমাণ করে যে বাঙালি জনগণ আর পশ্চিম পাকিস্তান–নির্ভর মুসলিম লীগকে বিশ্বাস করছে না।
গুরুত্ব ও উত্তরাধিকার
আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা কেবল একটি রাজনৈতিক দলের জন্ম নয়, বরং এটি ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদের রাজনৈতিক রূপায়ণ। এ দলের হাত ধরেই বাঙালি জাতির স্বকীয়তা, সাংস্কৃতিক পরিচয়, এবং রাজনৈতিক স্বাধীনতার স্বপ্ন সুস্পষ্ট আকার ধারণ করে।
পরবর্তীতে দলটি "আওয়ামী মুসলিম লীগ" থেকে "আওয়ামী লীগ" নামে পরিচিত হয়। এই দলই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেয়।
সারসংক্ষেপ: আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার পেছনে মূল কারণ ছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বৈষম্যমূলক নীতি, পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার উপেক্ষা এবং জনগণের গণতান্ত্রিক চেতনার উত্থান। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার রোজ গার্ডেনে প্রতিষ্ঠিত এই দল পরবর্তীতে আওয়ামী লীগে রূপান্তরিত হয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রধান নেতৃত্ব প্রদান করে। এটি কেবল একটি রাজনৈতিক দলের জন্মই নয়, বরং বাঙালি জাতিসত্তার জাগরণ ও মুক্তির পথে এক অবিস্মরণীয় পদক্ষেপ।
